টুবলু কি আর বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারছে? রাস্তায় বেরোতে পারছে? জানলায় বারান্দায় পর্যন্ত দাঁড়ায় না টুলু। ওর মনে হয় যেন বিশ্বসুদ্ধ লোক শুধু টুবলুর দিকেই তাকাচ্ছে। তাকাচ্ছে, আর ভাবছে এর মা এর বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আর এখন বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা তুলতে যাচ্ছে!
টুলু আর ভাবতে পারে না।
টুবলুর সমস্ত শরীরটা ঘেমে যায়। তবে টুলু একটা আতঙ্কের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। ও নিজে কোনো বন্ধুর বাড়িতে না গেলেও বন্ধুরা পাছে ওর বাড়িতে আসে এই ভয়ে কোনো পরিচিত গলাই বিশেষ একটি জানলার নীচে থেকে ডেকে উঠল না কৌশিক! কৌশিক!
না, এই কদিনের মধ্যে একদিনও না!
তার মানে কৌশিকের বন্ধুরা কৌশিককে ঘৃণা করছে। অথবা কৌশিকের এই পরিস্থিতিকে ভয় করছে। বড়োলোক বাবার একমাত্র ছেলে কৌশিক, স্নেহ-বিগলিত মায়ের একমাত্র সন্তান, কাজেই কৌশিক ছিল বন্ধুমহলে যেন মধ্যমণি। সেই কৌশিক এখন ঘৃণ্য, হাস্যাস্পদ।
যাক, তবু এও ভালো। ঘৃণা করে ত্যাগ করেছে তারা কৌশিককে। যদি তারা নিষ্ঠুর কৌতুকে কৌশিককে বিধতে আসত তাহলে কৌশিককে হয়তো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হত। কৌশিকের মা যেমন গেছে। নির্মম নির্লিপ্ত চিত্ত নিয়ে। মনে হত এ বাড়ির প্রত্যেকটি জিনিসের উপরই মায়ের অপত্য স্নেহ। এই বাড়িটার শোভা সৌন্দর্য আর পরিচ্ছন্নতা রাখবার জন্যে মা প্রাণপাত করতে পারে।
সেই প্রাণতুল্য বস্তুগুলোকে মা পথের ধুলোর মতো গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে যেতে পারল? হঠাৎ যেন বিশ্বাসই হয় না কৌশিকের, মা তার এই প্রিয় জিনিস-পত্তরগুলি, যা সে বাঘিনীর মতো আগলাত, সে-সব আর কোনোদিন হাত দিয়ে ছোঁবে না। বিশ্বাস হয় না, মায়ের ওই তিন আলমারি শাড়ি ব্লাউজ, আরও কত কি যেন, মা কোনোদিন আর পরবে না।
কৌশিক সেই অবিশ্বাস্য কথাটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হওয়ার মতো ভয়ঙ্কর দুঃখের সময়ে ভাবতে চেষ্টা করে, কত লোকের তো মা মারা যায়, কৌশিকেরও তাই—কিন্তু মারা যাওয়ার মধ্যে
তো শুধু ভয়ঙ্কর ওই কষ্টটাই থাকে, এমন লজ্জা থাকে কি?
আশ্চর্য! কৌশিক লজ্জায় মরে যাচ্ছে। অথচ কৌশিকের মা-বাবার মধ্যে লজ্জার লেশ নেই। না নেই।
সেদিনের সেই রাত্রেই জেনে ফেলেছিল কৌশিক। হ্যাঁ, যেদিন মা চলে গেল তার আগের রাত্রে।
গভীর রাত্রে, কৌশিক তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুম ভেঙে গেল একটা তীব্র চেঁচামেচির শব্দে। হতচকিত কৌশিক বিছানায় উঠে বসল। অনুমান করতে চেষ্টা করল এ গলা কার! তারপর ভয়ঙ্কর এক ভয়ে যেন পাথর হয়ে গেল কৌশিক। এ গলা কৌশিকের মায়ের গলা? মা এইরকম সব অকথ্য কথা বলছে?
রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে, চাকর-বাকর কান ফাটিয়ে মা বাবাকে বলছে, ছোটোলোক, ইতর নীচ নোংরা, রাস্তার কুকুর।
মায়ের সেই কোমল সুন্দর মুখটা থেকে অনর্গল বেরিয়ে আসছে এই সব গালিগালাজ? এই সব! আরও কত সব!
কৌশিক যে-সব কথার মানে জানে না, শুধু ছায়া-ছায়া একটা আতঙ্কের মতো যা চেতনার মধ্যে সবেমাত্র সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে, কৌশিকের মা সেই সব বলছে? জানা জগৎটায় এমন ভয়ানক অনিয়মের ঘটনা এর আগে ঘটতে দেখেনি। কৌশিক তাই ভয় পেল। তারপর কৌশিক একটা কাঁচের গ্লাস ভাঙার শব্দ পেল। কৌশিক একটা সিদ্ধান্তে এল।-বাবা তাহলে মদ খাচ্ছিল।
মা তাই–
কিন্তু তাই কি? আরও যে কী সব ভাঙছে মা আছড়ে আছড়ে। কী ও-সব? ফুলদানি? পুতুল? পাথরের সেই অ্যাশট্রেটা? হ্যাঁ, মা ভাঙছে। ওই আছড়ে ভাঙার শব্দগুলোর ওপর মায়ের গলার শব্দটাও যে আছড়ে আছেড়ে পড়ছে। ভাঙব, ভাঙব। তছনছ করে দেব তোমার মান-সম্রম, তোমার মুখোশ! তোমার জীবন ধ্বংস করে ছাড়ব!
বাবার গলাও কিছু বলছে, কিন্তু সে ভাষা উদ্ধার করতে পারছে না কৌশিক। সে গলা অনুত্তেজিত। কৌশিক ভাবল তবে কি মা নয়? আর কেউ? কিন্তু আর কে? তাছাড়া
কিছুদিন ধরেই তো বাড়িতে চলছে ঝগড়া অশান্তি। বাবা যে হঠাৎ খারাপ কিছু করছে, এবং মা তার প্রতিবাদ করছে, এটা টের পাচ্ছে কৌশিক। কিন্তু কি সেই খারাপটা ধরতে পারছে না। শুধু দেখছে বাবার রাত্রের খাওয়াটা অনিয়মিত হচ্ছে, রাত্রের ফেরাটা অনিয়মিত হচ্ছে।
কৌশিক ভাবত তাসের আড্ডায় দেরি করে বাবা। তারপর কৌশিক ভাবতে শুরু করল, মদ। নিশ্চয় মদ। কিন্তু আজ তো শুধু সেইখানেই থেমে থাকতে পারছে না কৌশিক। কৌশিকের কানের পর্দা ফুটো করে এক-একটা জ্বলন্ত শব্দ ঢুকে পড়েছে যে!
মিথ্যেবাদী, শয়তান! চরিত্রহীন, ময়লার মাছি, নর্দমার পোকা! মা, মা জানত এ-সব কথা? মায়ের স্টকে ছিল এইসব শব্দ? যে মা, কৌশিক একদিন বাড়ির চাকরকে পাজী বলেছিল বলে, ছেলের অধঃপতনে মরমে মরে গিয়েছিল।
কৌশিক তারপর বাবার উত্তেজিত গলাও শুনতে পেল, তুমি থামবে কি না?
কৌশিকের মা বলল, না, থামব না।
তবে চেঁচাও—কৌশিকের বাবা বলল। তবে এটা বোধহয় তোমায় শেখাতে হবে না, ধমকে ভালোবাসা আদায় করা যায় না। আর দুটো প্রাণকে একটা দড়ি দিয়ে একটা খোঁটায় বেঁধে রাখলেই তারা একাত্ম হয়ে যায় না।
তা যায় না। একাত্ম হয় শুধু—আরও একটা কাঁচের বাসন ভাঙার শব্দ পেল কৌশিক। আর হঠাৎ কৌশিক ভয় থেকে মুক্ত হল। মাঝখানের দরজাটা খুলে ফেলল।
দুটো ঘরের মাঝখানে যে বন্ধ দরজাটা ছিল।