থামো, চুপ কর। নির্লজ্জ, বেহায়া, অসভ্য! নন্দিতা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে আরও জোরে জোরে হাতের কাজ সেরে নিয়েছিল।
আর সেই সময় আরও একবার মনে হয়েছিল প্রদোষের, নন্দিতার গায়ে কত বেশি মাংস!
আরও কিছু কথা-কাটাকাটির পর নন্দিতা বেরিয়ে গিয়েছিল।—গিয়েছিল, তবু প্রদোষ ভাবেনি সেই যাওয়াটা সত্যি চিরতরে যাওয়া হবে। ভেবেছিল সংসার-অন্ত-প্রাণ নন্দিতা কদিন ওর এই সাধের সংসার ছেড়ে থাকতে পারবে? বাপের বাড়ি বসে বসে ভাববে চাকররা ওর ভোলা দামি চায়ের সেটগুলো বার করে ব্যবহার করে ভাঙছে কিনা, ওর ভাঁড়ারঘরের আধিপত্য পেয়ে একমাসের রসদ তিন দিনে শেষ করছে কিনা, ওর বাসন-কোসন, চাদর-পর্দা চুরি করে লোপাট করছে কিনা, আর ওর সাধের পুত্তুরটিকে সম্যক যত্ন করে খেতে দিচ্ছে কিনা। হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে প্রধান।
স্বামীর কথা হয়তো ভাববে না রাগে অন্ধ হয়ে, কিন্তু টুলুর কথা না-ভেবে পারবে না। এইসব ভেবে স্বস্তিতেই ছিল প্রদোষ, ছিল নিশ্চিন্তে। কিন্তু কদিন পরে জানল বাপের বাড়িতে যায়নি নন্দিতা।
সেরেছে! তবে কোথায়? রাগের চরম নিদর্শন দেখাতে কোনো মফঃস্বলে স্কুলে মাস্টারি করতে যায়নি তো? গল্পে-উপন্যাসে যা দেখা যায়। খোঁজ করতে লাগল। কারণ সংসারটা ছন্নছাড়া করতে চায়নি প্রদোষ। সমস্ত ছন্দ অব্যাহত রেখে ও শুধু জীবনে একটু নতুন রসের আমদানি করতে চেয়েছে।
আশ্চর্য, সেটা কি এতই বেশি চাওয়া? আচ্ছা, নন্দিতাই বা এই ষোলো বছরের পুরনো জীবনটাতে ক্লান্ত হচ্ছে না কেন? এ জীবন রসহীন লাগছে না কেমন ওর?
ওই অভ্যাসের সংসারে বাঁধা নন্দিতাকে করুণা করেছিল সেদিন প্রদোষ, তার বেশি নয়। কিন্তু এখন রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার। কারণ এখন শুনছে নন্দিতা ডিভোর্স চাইচে। বান্ধবীর বাড়িতে খুঁটি গেড়ে তার তোড়জোড় করছে। আর করছে হয়তো প্রদোষেরই টাকায়। সর্বস্ব তো নন্দিতার অধিকারেই ছিল। সেই অধিকারের সুখটা কিছুই নয়?
প্রদোষকে সে কোর্টে দাঁড় করিয়ে ছাড়বে, আর সেই সঙ্গে প্রকাশ করে দেবে চারুতোষ পালিতের স্ত্রীর সঙ্গে প্রদোষের কেলেঙ্কারীর কাহিনি। ইটের মতো কঠিন মুখে হঠাৎ একা ঘরেই অদৃশ্য নন্দিতার সামনে বুড়ো আঙুল দেখাল প্রদোষ। কিছু প্রমাণ করতে পারবে না হে, মহিলা! চারুতোষ নিজে সাক্ষী দেবে তার স্ত্রীর মতো পতিব্রতা সতী স্ত্রী দুনিয়ায় আর দুটি নেই।
তাছাড়া—কবে তুমি আমাদের দুজনকে একত্রে দেখেছ? না, তেমনভাবে কিছুই দেখনি। কারণ তুমি আগে টেরই পাওনি কে তোমার স্বামীর হৃদয় হরণ করেছে। হারানোর অনুভবটাতেই উন্মাদ হচ্ছিলে তুমি।
আমি, এই আমি, তোমার সত্যবাদী স্বামী নিজে মুখে যদি না-বলতাম, অন্ধকারেই থাকতে তুমি। এখন তুমি সেই সুযোগটি নিচ্ছ।
ঠিক আছে, দেখি তুমি কী করতে পার।
যদি তুমি নিজে এই ঘর-ছাড়ার কেলেঙ্কারীটা না করতে, হয়তো আমি তোমার প্রতি সামান্যতম মমতাটুকু অন্তত রাখতাম। কিন্তু আর এখন ওই মমতার প্রশ্নটুকুও থাকবে না।
যেন আক্রোশের মনোভাব নিয়েই বেরিয়ে পড়ল প্রদোষ চারুতোষ পালিতের বাড়ির লক্ষ্যে। খেয়াল করল না, আর একটা জায়গায় হয়তো একটু মমতার প্রশ্ন রাখা উচিত ছিল।
বাবার বেরিয়ে যাওয়া তাকিয়ে দেখল টুবলু তার দোতলার পড়ার ঘর থেকে। গাড়ির গর্জন। শুনতে পেল, ধপাস করে দরজা বন্ধ করার শব্দটাও শুনতে পেল। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বসে রইল। টুবলু হাতের বইটা টেবিলে ফেলে রেখে। টুবলু জানে বাবা কোথায় যাচ্ছে। শুধু আজ বলেই নয়। অনেকদিনই ধরেই জানে। কারণ অনেকদিন থেকেই তো বাবার অনিয়মিত গতিবিধি নিয়ে মায়ের অনুযোগ-অভিযোগ শুনছে। শুনছে তর্ক-ঝগড়া, আর কথা-কাটাকাটি।
এক একদিন রাত্রে উদ্দাম হয়ে উঠত মায়ের কণ্ঠ, আর মনে হত—মা বুঝি ফেটে পড়বে।
মনে হত, মা বুঝি এই দণ্ডে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। তা সেই বেরিয়েই গেল মা। রাত্রে না হলেও গেল। দিনে-দুপুরেই গেল। টুলুকে একবার বলেও গেল না।
প্রথম কদিন কথাটা মনে করলেই টুবলুর চোখ দুটো জ্বালা করে উঠত, এখন আর করে না। এখন শুধু একটা দাহ! চোখে, মনে, সর্বাঙ্গে। একটা বেলা নাকি মা টুবলুকে চোখের আড়াল করতে পারত না। স্কুল থেকে এন.সি.সি-র ক্যাম্পে যাবার কথা হয়েছে, মা নানা ছল-ছুতোর টুলুর (বহির্জগতে যার নাম কৌশিক) যাওয়া বন্ধ করেছে। টুবলু রাগ করলে মা কত তোয়াজ করে করে ভুলিয়েছে, কত প্রলোভন দেখিয়ে বশে এনেছে।
আর অন্য যে-কোথাও যেতে চাইলে? মা বলত, আহারে বাহাদুর সর্দার, তোমায় আমি একলা ছাড়ব? যা বেহুশ ছেলে তুমি। বলে নিজের হাত-পায়েরই ঠিক নেই তোমার! কেউ ডেকে না-খাওয়ালে তো তিনবেলা না খেয়ে পড়ে থাকবি।
তা কোথায় গেল তোমরা সেই মাতৃ-স্নেহের গৌরব?
টুবলু—না, টুবলু না বলে যাকে এখন কৌশিক বললেই বেশি মানাবে, সে মনে মনে তীব্র প্রশ্ন করে, কোথায় গেল? মনে হত অন্ধস্নেহে বিগলিত তুমি, কোথায় সেই স্নেহ-সমুদ্র?
তার মানে ছিলই না কোনোদিন সে জিনিস। তার মানে সবটাই তোমার শো ছিল। ভাবতে গেলেই যেন মাথার মধ্যে আঁ আঁ করে ওঠে, সমস্ত অতীতটা তালগোল পাকিয়ে ঝাঁপসা হয়ে যায়। টুবলুর সেই মা, টুলুর বিগত সমস্ত জীবনটা ভরে আছে যার অস্তিত্বে, সেই মা টুবলুর সঙ্গে কথা পর্যন্ত না বলে চলে গেল টুবলুর মুখে কালির প্রলেপ লাগিয়ে দিয়ে।