নন্দিতাও এখন প্রদোষের মতোই অনমনীয়। তাই নন্দিতা বিরক্ত গলায় বলে, থাম থাম, তোকে আর পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে আসতে হবে না। এখন বুঝছি ওসব স্রেফ জোচ্চুরি।
শিখা বিষণ্ণ গলায় বলে, আজ হয়তো তাই দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু তখন সেটা জোচ্চুরি ছিল না নন্দিতা!
আমি বিশ্বাস করি না। যদি খাঁটি হত তাহলে আজ এভাবে—
মানুষ মাত্রেরই মতিভ্রম হতে পারে নন্দিতা, এখন ওকে পেত্নীতে পেয়েছে, তাই ওর বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে গেছে। কিন্তু এ ভুল ওর ভাঙবে। আমি বলছি, দেখিস তুই–
নন্দিতা তার সুন্দর মুখটা বিকৃত করে বলে, ওঃ, তাহলে বলতে চাস তোর এই ভবিষ্যৎ বাণী ফলবার আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনব বসে বসে? কবে তাঁর ভ্রষ্টবুদ্ধি ফিরে আসবে, কবে তিনি আবার এই দাসীর দরজায় এসে দাঁড়াবেন! গলায় দড়ি আমার! আমি তোর ওই যীশুখ্রিস্টের প্রেমের বাণী শুনতে চাই না বাবা, সাদা বাংলা হচ্ছে—ওকে আমি কোর্টে দাঁড় করাব।
হ্যাঁ, এই সংকল্পে বদ্ধপরিকর হয়েছে নন্দিতা, এই মন্ত্র জপ করছে–ওকে আমি কোর্টে দাঁড় করাব। ওর সব কেলেঙ্কারী ফাঁস করে দেব। ষোলো বছর ধরে যে ফাঁকির মধ্যে বসে নির্বোধের মতো ঠকে এসেছি তার শোধ তুলব।
শিখা আবার বলে কিনা তখন সেটা কি ছিল না। তার মানে খাঁটি-সোনার কণ্ঠহারটা আমার হঠাৎ একদিন পেতল হয়ে গেল! শিখা বলতে পারে, শিখা পুরুষজাতটার স্বরূপ জানে না। তাই উপদেশ দিতে পারে—ব্যাপারটাকে এতবড়ো করেই বা দেখছিস কেন?
এ যুক্তি প্রদোষও দিয়েছিল সেদিন, যেদিন চলে এসেছিল নন্দিতা। নন্দিতাকেও নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছিল প্রদোষ। বলেছিল, ব্যাপারটাকে এতবড়ো করেই বা দেখছ কেন তা-ও তো বুঝছি না!
বুঝছ না?
সত্যিই বুঝছি না। কোথাও তো কিছু ব্যাহত হচ্ছে না তোমার! তোমার সংসারে তুমি যেমন ছিলে তেমনিই আছ, আমিও কিছু বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি না। বাইরে রাত্রিবাসও করছি না। শুধু তোমার সঙ্গে কপটতা না করে অকপটে স্বীকার করছি, তোমাতে আমি একনিষ্ঠ থাকতে পারছি না। শুধু এই–
শুধু এই! তা বটে।
নন্দিতা অনেক ঢেউ খেয়ে তবে অকূলে নৌকো ভাসাতে নেমেছিল, তাই নন্দিতা আর রুদ্ধকণ্ঠ হল না। স্থির গলায় বলল, আমার সংসার, এই ফাঁকিটাকে আর হজম করা সম্ভব নয়।
কিন্তু ভেবে দেখ—
প্রদোষ ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে পায়চারি করতে করতে বলেছিল, এই ফাঁকিটাকে নিয়ে হই চই করে বেড়ালে–মান-সম্রম কমবে বৈ বাড়বে না।
তোমার ওই মেকি মান-সম্ভ্রমের দাম আমার কাছে কানাকড়িও নয়।
তবে ব্যাপারটা হবে এই, প্রদোষ বলেছিল, তোমার আজকের এই ফঁকির খবরটা এমন চাউর করে বেড়ালে, তোমার বিগত ষোলো বছরের জলজ্যান্ত জীবনটাও স্রেফ ফকির খাতায় জমা হবে। লোকে ভাববে–
জলজ্যান্ত জীবন? ঘৃণায় মুখটা বাঁকিয়েছিল নন্দিতা, আগাগোড়াই ধাপ্পাবাজি ছিল তোমার, এখন বুঝছি! লোকে যদি সেটা বুঝতে পারে বুঝবে।
তখন প্রদোষ একটু যেন বিষণ্ণ গলায় বলেছিল, আগাগোড়াই ধাপ্পাবাজি ছিল এতটা–ভাবলেও পারতে নন্দিতা! যখন ছিল, সেটা খাঁটিই ছিল।
নন্দিতা অপমানের জ্বালায় জ্বলছিল।
নন্দিতা তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে, চিরকালের মতো চলে যাবার জন্যে, ছোট্ট একটা সুটকেসে দু-একটা জামাকাপড় ভরে নিচ্ছিল, রাগে হাত-পা কাপছিল তার, তাই মুখবিকৃত করেছিল। বলেছিল, চুপ করো, চুপ করো। একটি কথা বলতে এসো না। খাঁটি ছিল! নির্লজ্জ মিথ্যেবাদী!
প্রদোষ হেসে উঠেছিল। হেসে বলেছিল, নির্লজ্জ একশো বার, কিন্তু মিথ্যেবাদী নয়। আজ হয়তো সে প্রেমের কিছু অবশিষ্ট নেই, কিন্তু এক সময় ছিল। আর তার মধ্যে ভেজাল ছিল না।
কিন্তু কে বিশ্বাস করবে ভেজাল ছিল না? কে বিশ্বাস করবে যখন ভালোবেসেছে প্রদোষ। নন্দিতাকে, প্রাণ দিয়েই বেসেছে। না, বিশ্বাস করা যায় না। কারণ এখন প্রদোষ পরকীয় রসে ডুবে পড়ে আছে। এখন চারুতোষ পালিতের স্ত্রীর সাপের মতো চকচকে দুখানা হাত অহরহ আকর্ষণ করছে প্রদোষকে।
প্রদোষ তবু চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা বড় সেকেলে হয়ে গেছে নন্দিতা, ওটা বাদ দিয়ে আর কিছু হয় না? মানে, আর কোনো নতুন একটা শাস্তি ঠিক কর না!—আর এটা তো ঠিক আমায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, শান্তি দেওয়া হচ্ছে তোমার গৃহপালিত পোষ্যদের। তোমার এই গৃহিণীশাসিত সংসারে ভৃত্যদের এমন অবস্থা যে, নিদের্শ ব্যতীত কোনো কাজই করতে পারে না তারা। তোমার ওই অঞ্চলের নিধি পুত্রকে এমন খোকা করে রেখেছ যে, মা ছাড়া তার বিশ্বভুবন অন্ধকার
এইভাবে ম্যানেজ করতে চেষ্টা করেছিল প্রদোষ। যেন নন্দিতার এই চলে যাওয়াটা একটা হাস্যকর ছেলেমানুষী! যেন নন্দিতা চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলছে।
কিন্তু নন্দিতা তখন মরিয়া। তাই নন্দিতা বলেছিল, ধরে নিতে হবে ওর মা মরে গেছে। হঠাৎ একটা মৃত্যু, সংসারে অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
মৃত্যু! কিন্তু মৃত্যুর মধ্যে একটা সান্ত্বনা থাকে। নিরুপায়তার সান্ত্বনা। যেহেতু সেটা অমোঘ, অনিবার্য।
এটাকেও তাই বলে ভাবা হোক।
কিন্তু আমি বলছিলাম, মাত্র আমাকে, মানে মাত্র আমার হৃদয়টুকুকে বাদ দিচ্ছি বৈ তো নয়। সেই তুচ্ছ একটা হাইফেনের অভাবে এ সংসারের কী এমন ছন্দপতন হবে? বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি না আমি, আর্থিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাইছি না