প্রদোষ তার নবলব্ধ বন্ধু চারুতোষ পালিরে পরিবারের সঙ্গে রানিক্ষেত চলে গিয়েছিল।
নন্দিতাকেও অতএব ছোড়দাকে সঙ্গে নিতে হয়েছিল। এবং প্রদোষের সঙ্গে যথেষ্ট কথা-কাটাকাটি আর মান-অভিমানের পালা চললেও অন্যরে বলেছিল, অফিসের বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছেন আর জানোই তো পুরুষের একদিকে সমগ্র পৃথিবী আর একদিকে অফিস। তা পাল্লাটা ঝুঁকি হয় ওই শেষটাতেই।
এই বলে মান বাঁচিয়েছিল নন্দিতা সেদিন।
অথছ প্রদোষ এখন নন্দিতাকে ঘৃণা করছে। প্রদোষ ভাবছে, নির্বোধ নন্দিতা তার ব্যাঙ্ক-ফেলের খবরটা ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু একদিনে কি বলে বেড়িয়েছিল নন্দিতা? একদিনেই কি উদঘাটিত হয়েছিল?
যখন প্রদোষ রানিক্ষেত থেকে ফিরে এসেছিল, আর বোঝা গিয়েছিল প্রদোষ তার আত্মাকে বিক্রি করে এসেছে, তখন কি বহু ছলনার মলাট দিয়ে দিয়ে নিজের জীবনের এই ব্যাঙ্ক-ফেলের কাহিনি ঢাকেনি নন্দিতা? ক্রমশ নন্দিতা ধৈর্য হারিয়েছে, প্রতিক্রিয়ায় প্রখর হয়েছে।
কিন্তু তার আগে? নন্দিতা তার স্বামীর বিকিয়ে-যাওয়া আত্মাকে ফিরে কিনে নেবার জন্যে অনেক মূল্য ধার্য করেছে, অনেক দর দিয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি। নন্দিতা যত চেষ্টা করেছে, যত মান-অভিমান করেছে, প্রদোষের ততই নন্দিতাকে বোরিং লাগতে শুরু করেছে, সাংসারকে বিরক্তিকর মনে হয়েছে, তার সন্তানকে অবান্তর লেগেছে।
প্রদোষের যে একটা তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলে আছে, এটা প্রকাশ করতে যেন এখন লজ্জাবোধ করে প্রদোষ। আর ওই ছেলেটার জন্যে নন্দিতাকে দায়ী করে। বিয়ের দু-বছরের মধ্যেই বাচ্চা-কাচ্চা আসুক এটা পছন্দ ছিল না প্রদোষের, কিন্তু চির যশোদা নন্দিতা তুমুল ঝড় তুলে প্রদোষের এ মতবাদকে খণ্ড খণ্ড করে দিয়েছিল।
কিন্তু বিধাতা বাদী। নন্দিতার পক্ষে বাদী। ওই একটি সন্তানের সঙ্গে সঙ্গেই নন্দিতার ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে। বড়ো একটা অপারেশনের শেষে জবাব দিয়েছে ডাক্তার। তাই টুবলু নন্দিতার প্রাণ মন ইষ্ট।
কিন্তু প্রদোষেরও তো তাই হওয়া উচিত ছিল? হিসেবমতো তাই ছিল বৈকি। কিন্তু প্রদোষের মতে মানুষ ছাঁচের পুতুল নয়, মানুষ অঙ্কশাস্ত্রের সংখ্যা নয়, মানুষ হচ্ছে জলজ্যান্ত প্রাণী। যার মধ্যে অজস্র ভঙ্গি, অজস্র রূপ, অজস্র রং। তাই মানুষের মন কেবল উচিতের খাতে বইতে পারে না। অতএব প্রদোষ ছেলেকে বলে তার মায়ের বিজনেস।
ছেলের সম্পর্কে কোনো চিন্তা মাথায় নেয় না প্রদোষ। আর এতবড়ো একটা ছেলে আছে তার, এটা ভেবে যেন অস্বস্তি পায়। কিন্তু তার জন্যে তো কোথাও কোনো অভিযোগ ছিল না। কাজেই সুখেরও বিঘ্ন ছিল না। পরিচিত মহলে সকলেই তো জানত ওরা একটি সুখী দম্পত্তি। ওদের ভালোবাসাটা তুলনাস্থল ছিল। কারণ ওদের ভালোবাসার গোড়ার ইতিহাসটা যে বেশ সমারোহময় ছিল।
আর এখন?
এখন প্রদোষ অনুপস্থিত নন্দিতার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনুচ্চারিত উচ্চারণে বলে চলেছে, হ্যাঁ, স্বীকার করেছি হে মহিয়সী মহিলা, একদা আমি তোমার জন্যে পাগল হয়েছিলাম। তোমার জন্যে লজ্জা-সরম বিসর্জন দিয়েছি, দিনের পর দিন কলেজ কামাই করেছি, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করেছি, নিজের বাড়িতে লড়েছি, তোমাদের বাড়িতে লড়েছি…।
তারপর তোমাকে জিনে এনে বিজয়লব্ধ ঐশ্বর্য গলায় ঝুলিয়ে বেড়িয়েছি। অনেকদিন ধরে বেড়িয়েছি। কিন্তু যদি আজ আমার তোমাতে ক্লান্তি আসে, সেই আদি প্রেমিক শিবঠাকুরের মতো সতীর মৃতদেহের ভার কাঁধে করে বেড়াব?
কেন?
কেন তা চাইবে তুমি?
তুমি থাক তোমার মনে, আমি থাকি আমার মনে। চুকে গেল। যা ছিল, কিন্তু আজ আর নেই, সে জীবন আর চেও না তুমি।
কিন্তু আর তো নন্দিতা তা চাইছে না। চেয়েছিল। প্রথমে চেয়েছিল, এখন নন্দিতা বিচ্ছেদ চাইছে। নন্দিতা ওই অপমানকর দাম্পত্য-জীবনের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখতে চাইছে না।
অথচ প্রদোষ তা চাইছে না। প্রদোষ ওই সব গণ্ডগোলের মধ্যে যেতে নারাজ। প্রদোষ জানে, চারুতোষের স্ত্রীর সঙ্গে তার এই লীলাসঙ্গিনীর সম্পর্কটাই শেষ কথা। কোনো কবি-কল্পনা, কোনো রোমাঞ্চময় স্বপ্নের মধ্যেও সে সম্পর্ক জীবন-সঙ্গিনীতে পর্যবসিত হবার প্রশ্ন নেই। আর তা চায়ও না প্রদোষ।
এই দায়হীন ভারহীন শুধু ভালোলাগার জীবনে যে মাধুর্য, সেটাই তো কাম্য। প্রেমের উপর যেই দায় চাপে, ভার চাপে, সে ক্লিষ্ট হয়ে যায়। এখন কি বিশ্বাস হয়, একদা প্রদোষ নন্দিতার জন্যে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করেছে? অথচ করেছে তা। আর তখন প্রদোষের নন্দিতাকে অসহ্য লাগছে।
কিন্তু নন্দিতাও তো সে একই দোষে দোষী। নন্দিতার বান্ধবী তো কম চেষ্টা করছে না ওকে সেদিনের কথা মনে পড়াতে! শিখা তো সেই তাদের মধুর রোমাঞ্চময় উন্মাদ-আবেগময় দিনগুলির সাক্ষী। শিখার জীবনে কখনও প্রেমের পদপাত ঘটেছে কিনা, শিখার অন্তরঙ্গ বান্ধবী নন্দিতাও জানে না। অতএব ধরে নিতে হবে ঘটেনি।
কিন্তু শিখা ওদের সেই ঘটনার দিনগুলি নিখুঁত মনে রেখেছে। তাই শিখা ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রদোষের সেই বেলা চারটে থেকে পার্কের বেঞ্চে বসে রোদে পোড়ার কথা তোর মনে আছে নন্দিতা?…ওর সেই আমাদের কলেজের পথে ফুটপাতে পায়চারি করার কথা?…আচ্ছা, আর সেই একদিন তোক নিয়ে সরে পড়ে স্টিমারে বেড়িয়ে আনা? শেষ অবধি আমাকে তোদের বাড়ি গিয়ে মিথ্যে সাক্ষী দিতে হল, তুই রাত আটটা পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই ছিলি!…প্রদোষের সেদিন কী কৃতজ্ঞতা! আর–