চারুতোষ ওদের পুরনো বন্ধুদের দলের নয়, চারুতোষের সঙ্গে আলাপ ক্লাবের সূত্রে। সস্ত্রীক গিয়েছিল সেদিন সবাই ক্লাবে, কোন একটা বিশেষ উৎসবে। নন্দিতা বাড়ি ফিরে বলেছিল, উঃ তোমাদের ওই পালিত সাহেবের বৌটা কী বাচাল বাবাঃ! অতগুলো মেয়ে-পুরুষের মধ্যে যেন উছলে বেড়াচ্ছে। তাও যদি রূপ থাকত!
প্রদোষ সেদিন অভ্যাসমতো কথা মেনে নেয়নি। প্রদোষ সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলেছিল, রূপ থাকলে নেচে বেড়ানোর রাইট থাকে?
সে-কথা হচ্ছে না, নন্দিতা বলেছিল, কুচ্ছিরা নেচে বেড়ালে আরও বেশি খারাপ লাগে, তাই বলছি। ওই কালো সিঁড়িঙ্গে চেহারা, হাত দুটো আবার তেমনি লম্বা, সেই হাত দুখানা স্রেফ খালি করে–
স্রেফ খালি কেন? ঘড়ি ছিল তো?
ঘড়ি তো এক হাতে, অন্য হাতটা? তখনও নন্দিতা নিঃসন্দিগ্ধ ছিল, তাই নন্দিতা বলতে পেরেছিল, যত কথা, তত হাত নাড়া! বাবাঃ!
সেদিন প্রদোষ শেষ অবধি মৃদু হেসে বলেছিল, তোমরা মেয়েরা একজন আর একজনকে সহ্য করতে পার না।
আর নন্দিতা মৃদু হেসে বলেছিল, আর তোমরা পুরুষরাও বাচাল মেয়েমানুষ দেখলেই আর ধৈর্য ধরতে পার না। অগ্নিতে পতঙ্গবৎ ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাও। বলেছিল একথা নন্দিতা। নিতান্তই ব্যঙ্গ-কৌতুকে।
স্বপ্নেও ভাবেনি, বিধাতা অলক্ষ্যে হাসলেন। কি করে ভাববে?
বিপাশাকে নিজের প্রতিদ্বন্দিনী ভাববার কথা যে নন্দিতার কল্পনার বাইরে।
যা কল্পনার বাইরে, তা সন্দেহের মধ্যে আসবে কি করে? নন্দিতাকে যদি সেদিন নন্দিতার বিধাতা সতর্ক করেই দিতে আসতেন, নন্দিতা কি সেই পরামর্শ নিত সভয়ে?
নন্দিতা কি হেসে উড়িয়ে দিত না সেই সতর্কবাণী? তাই দিত। নন্দিতার বুক বাঁধা ছিল। তখনও ছিল। নন্দিতা ভাবতে পারেনি ওই সৰ্পবাহুযুগল নন্দিতার জীবনের মধুচক্রের দিকে প্রসারিত হবে। সাপের মতো ছোবল হেনে তুলে নেবে নন্দিতার জীবনের সুখগুলি, শান্তিগুলি, ছোটো ছোটো ইচ্ছার ফুলের তোড়াটি।
হ্যাঁ, ছোটো ছোটো ইচ্ছে নিয়েই জীবন ছিল নন্দিতার তখন। নন্দিতা তখন ভাবছিল ছেলেটার স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে দার্জিলিং বেড়াতে যাবে। দুবার যাওয়া হয়েছে? তাতে কি? ভালো জায়গায় শতবার যাওয়া যায়।
নন্দিতার এ-যুক্তি খণ্ডন করে দিয়েছিল প্রদোষ, বলেছিল, আমার বোরিং লাগে।
বাঃ, টুবলু কি ভালো করে দেখেছে? একবার যখন যাওয়া হয়েছিল, ও তো জন্মায়নি, আর একবার নেহাত বাচ্চা মাত্র, মনেই নেই কিছু। টুবই দার্জিলিং-দার্জিলিং করছিল–
প্রদোষ সেদিন আদর্শ পিতার চাইতে খারাপ কিছু ব্যবহার করেনি। প্রদোষ হেসে বলেছিল, তবে তাই! তোমার টুবলু যখন ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন! এর ওপর আর কথা কি?
নন্দিতা কালো দুচোখে আলোর ঝিলিক হেনে বলেছিল, আহা, আমি বুঝি ছেলের সব ইচ্ছেকেই প্রশ্রয় দিই?
দাও কি না-দাও তুমিই জানো। প্রদোষ বলেছিল, তোমাদের মাতা-পুত্রের ব্যাপার তুমিই জানো।
আহা রে! আমাদের মাতা-পুত্রের ব্যাপারে তোমার কোনো ভূমিকা নেই, কেমন? নন্দিতা ঝলসায়, ঝঙ্কার দেয়, নন্দিতার মস্তবড়ো খোঁপাটা ঘাড়ে ভেঙে পড়ে, আর সেই মুহূর্তে রোজ ওই দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত প্রদোষের হঠাৎ মনে হয়, একগাদা চুল কী বিশ্রী! মেয়েদের গ্রীবার যে একটা বিশেষ সৌন্দর্য আছে, এটা আমাদের মেয়েরা জানেই না। তারপর মনে হয়েছিল, কেউ কেউ জানে অবশ্য। তাই চুলগুলো হেঁটে খাটো করে নেয়।
প্রদোষ সেই দৈবাৎ-দেখা এক-আধটা গ্রীবার সৌন্দর্যের কথা ভাবতে ভাবতে বলেছিল, আমার ভূমিকা? কই, খুঁজে তো পাচ্ছি না! এইটুকু শুধু জানি, তোমরা যেখানে যেতে ইচ্ছুক হবে, অমোঘ আইনের বলে আমাকেও সেখানেই যেতে হবে। কারণ ভোটে তোমাদের জয়ই অনিবার্য।
তখনও সেই কথা বলেছিল প্রদোষ। হয়তো তখনও প্রদোষের সেই বিশ্বাসই ছিল।
কিন্তু হঠাৎ যাত্রার কদিন আগে যখন প্লেনের টিকিট সংগ্রহ হয়ে গেছে, তখন প্রদোষ বলে বসল, এই নন্দিতা, এক কাজ করো, তোমার ছোড়দাকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও।
ছোড়দাকে? আমাদের সঙ্গে? নন্দিতা বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, তার মানে?
মানে অতি প্রাঞ্জল, আমি আর ওই তোমার দার্জিলিংয়ে যাচ্ছি না, যাচ্ছি রানিক্ষেত। আমার টিকিটটা তো রয়েইছে, তাছাড়া তোমাদেরও একটা গার্জেন হবে, তাই বলছি ছোড়দাকে। অভ্যাসের অতিরিক্ত দ্রুত কথা বলেছিল সেদিন প্রদোষ।
কিন্তু নন্দিতা? নন্দিতা অভ্যাস-বহির্ভূত থেমে থেমে কথা বলেছিল, কিন্তু হঠাৎ তোমারই বা রানিক্ষেতে যাবার দরকার কি হল, আর আমাদেরই বা অভিভাবক বদলের প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
বাঃ, আমি তো গোড়া থেকেই বলছি দার্জিলিংয়ে যাবার আমার কোনো আকর্ষণ নেই।
নন্দিতা তখনও নিশ্চিন্ত, তাই নন্দিতা স্বামীর গায়ের ওপর এলিয়ে পড়ে বলেছিল, তা অন্য আকর্ষণ তো আছে? না কি নেই?
প্রদোষের হঠাৎ মনে হয়েছিল, নন্দিতা কি ভারী! মনে হয়েছিল, নন্দিতার গায়ে বড়ো বেশি মাংস। তবু প্রদোষ তার মুখের ওপর বলেনি সে কথা। কারণ তখনও প্রদোষ অনেস্ট হয়নি। তাই প্রদোষ রহস্যের হাসি হেসে বলেছিল, সে আকর্ষণকে তীব্র করতে, মাঝে মাঝে বিরহ ভালো।
আর বেশি তীব্র দরকার নেই, নন্দিতা বলেছিল, যা করছিলে, করো। যেমন যাওয়া হচ্ছিল হোক। রানিক্ষেত যাব! অতয় কাজ কি? যখন যাব, সবাই যাব।
বলেছিল। কিন্তু হয়নি।