প্রান্তিক ওই সত্যভাষণের গর্বে গর্বিত মুখটার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
প্রদোষ কেমন একরকম কৌতুকের দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরই অসহিষ্ণুভাবে উঠে দাঁড়ায়। এভাবে বোকার মতো এতক্ষণ তর্ক করার কোনো মানেই হল না। সোজাসুজি বলে দিলেই হত, আমি শিশু নই প্রান্তিক যে, তুমি সদুপদেশ দিয়ে আমায় বিপথ থেকে সুপথে আনবে।
হ্যাঁ, অত কথা না-বলে এইটুকু বললেই যথেষ্ট হত। উপদেশ দেওয়ার মুরুব্বিয়ানা ঘুচে যেত সাহিত্যিকের। মুরুব্বিয়ানা করবার সুযোগ অনেকেই পেয়েছেন। এই তো সেদিন নন্দিতার বড়োদিদি এসে অনেক সাধুবাক্য বলে গেলেন। যেন দুটো বাচ্চা ছেলে-মেয়ে খেলা করতে করতে ঝগড়া করেছে, তিনি মিষ্টি তিরস্কার আর হিত উপদেশ দিয়ে মিটিয়ে দেবেন! রাবিশ!
প্রদোষের পাজামার পা দুটো লটপটাচ্ছে, প্রদোষের গেঞ্জির স্ট্র্যাপটা কাঁধে ঝুলে পড়েছে, প্রদোষকে এখন খুব ঢিলে-ঢালা দেখাচ্ছে। তবু প্রদোষ সেই ঢিলে-ঢালা হয়েই ঘরের মধ্যে জোরে জোরে পায়চারি করতে থাকে। আর নন্দিতার উপর একটা ক্রুদ্ধ আক্রোশ অনুভব করে।
এইটি করেছে নন্দিতা। এই অন্যকে মুরুব্বিয়ানার সুযোগ দেওয়া।
আত্মসম্মান! আত্মসম্মানের বড়াই নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন! কি? না, ভালোবাসাহীন স্বামীর ঘরে থাকবেন না আর! আত্মসম্মানের হানি তাতে। রাবিশ!
আত্মসম্মানের বানানটাও জানে না। জানলে নিজের এই ব্যাঙ্ক-ফেলের খবরটা ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াত না।
তুমি মহিয়সী মহিলা, নিজের কেন্দ্রে স্থির ছিলে বাবা, নিজের পদমর্যাদায় অটল। ইচ্ছে করলেই এই দৈন্যের খবরটা ছেপে ফেলতে পারতে তুমি। সংসারের সর্বেসর্বা কী হয়ে, ভৃত্যবর্গের উপর দুর্ধর্ষ মণিবাণী হয়ে, সন্তানের মাতৃরূপে মহিমময়ী হয়ে, এবং একটা তরলমতি স্বামীর সম্পর্কে অগ্রাহ্যবতী হয়ে বেশ কাটিয়ে দিতে পারতে তুমি।
অথবা তোমার অনুগতজনদের প্রশ্রয় দিয়ে বড়িতে ডেকে আড্ডা বসাতে পারতে রোজ, নিজে হাতে কফি বানিয়ে খাইয়ে ধন্য করতে পারতে তাদের, আবার তরুণীর ভূমিকায় লাভলি হয়ে উঠতে পারতে। বয়েসটা পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হলেও রূপলাবণ্যে আজও তুমি তেইশ-চব্বিশকে হারাতে পার। অতএব আমার এখন তোমাকে বোরিং লাগলেও, এখনও দু-চারটেকে ঘায়েল করবার ক্ষমতা তুমি রাখো।
হঠাৎ শব্দ করে উচ্চারণ করে প্রদোষ—আর তাতে আমি ঈর্ষান্বিতও হতাম না। বরং মুক্তিই পেতাম। তুমি তাহলে তখন যে বস্তু আমার আর নেই, ফুরিয়ে গেছে, সেটাকে পাবার জন্যে আমার ওপর জুলুম করতে আসতে না।
তারপর বসে পড়ে প্রদোষ। বিড়বিড় করে বলে, কিন্তু তুমি দুটোর একটাও করলে না। তুমি ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে বান্ধবীর বাড়িতে বসে থাকলে। তার মানে, নিজের দৈন্যের ঘরটা খুলে খুলে দেখালে সবাইকে। চাকর-বাকরের কাছে হাস্যাস্পদ হলে, বন্ধুজনের কাছে হাস্যাস্পদ হলে। ছেলের কাছে ছোটো হয়ে গেলে।
এরপর আবার যেদিন তুমি এই চৌকাঠের মধ্যে এসে ঢুকবে, তখন কি সেই তোমার পুরনো পোস্টটা ফিরে পাবে?—পাবে না। তার কারণ ওই অবজ্ঞার দৃষ্টিগুলো সঞ্চয় করেছ তুমি। আর সেটা করেছ সম্পূর্ণ হঠকারিতা করে।
আমি তো বাপু তোমার অন্য কোনো অধিকারে হস্তক্ষেপ করিনি! তবে? তবে কেন তুমি এমন করে নিজের ক্ষতি করলে? ভেবেছিলে তোমার হতভাগ্য স্বামীটাকে লোকের কাছে হেয় করবে। হেয়টা যে তুমি নিজেই হয়েছ, হবে—তা ভেবে দেখছ না?
তোমার ওই বান্ধবী? যে তোমায় বড়ো সহানুভূতিতে আশ্রয় দিয়েছে? তোমার সেই মিস বান্ধবীটি হয়তো এখন মুখে তোমায় খুব সমর্থন করবে, কিন্তু আমি নিশ্চিত বলব, কখনো, সে সত্যিকার সমর্থন করবে না তোমায়। মনে মনে তোমায় আত্মসম্মানহীন বোকাই বলবে।
জানি না, মেয়েদের কথা মেয়েরাই জানে, তবে আমার কথা যদি বলি, বলব এ রকম ক্ষেত্রে আমি তোমার মতো বোকামি করতাম না হে নন্দিতাদেবী! আমি আমার স্ত্রীর ভালোবাসা হারানোর খবর বা স্ত্রীর অন্যের প্রতি আসক্তির খবর ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াতাম না। সমাজের পোজিশনটা রাখতাম। যেমন রেখেছে চারুতোষ।…তার স্ত্রীকে আর স্ত্রীর প্রণয়ীকে সান্ধ্যবিহারের সুযোগ দিতে রোজ বলছে, মাথাটা কেমন ধরেছে, আমি আজ আর বেরব না।
অথবা কোনো কোনোদিন বাড়িতে বসে আড্ডা দেবার সুযোগ দিতে বলেছে, তোমরা বসো, আমি একটু ঘুরে আসি।
এটুকু বলে কেটে পড়েছে, রাত দশটার আগে ফেরেনি! তারপর হাস্যবদনে এসে বলেছে, ইস্, এত দেরি করে ফেলোম!
তার মানে, চাকর-বাকরদের সামনে সি ক্রিয়েট করে মান খাটো করেনি। স্ত্রীর কাছেও এ খবরটা জানিয়ে খাটো হয়নি যে, তোমাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি গো, আর কিছুই নেই আমার।
বুদ্ধিমান লোক চারুভোষ।
চারুতোষের বুদ্ধির কথা ভাবতে গিয়েই হঠাৎ চারুতোষের বৌয়ের সেই সাপের মতো মসৃণ আর সাপের মতো চকচকে দুখানি হাতের কথা মনে পড়ে যায় প্রদোষের। দুইঞ্চি চওড়া কাঁধের ব্লাউজের গহ্বর থেকে নেমে এসেছে যে দুখানি হাত, কথা বলবার সময় লীলায়িত ভঙ্গিতে আন্দোলিত হবার জন্যে।
প্রদোষের হয়তো এখন আর মনে পড়ে না, কিন্তু প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিল ওই হাতের সৌন্দর্যেই। নইলে চারুতোষের বৌ বিপাশা তো রূপে-রঙে নন্দিতার ধারে-কাছেও লাগে না। কিন্তু রূপ তো শুধু রঙে নয়, গড়নে নয়, অদৃশ্য কোনো লোকে তার বাস। আর সে শুধু এক-একজরে চোখে এক-একরকম হয়ে ধরা দেয়। ময়লা-রং বিপাশার ওই একেবারে নিরাভরণ সাপের মতো চকচকে হাত দুটো তো চারুতোষের চোখে কুদৃশ্য। অথচ প্রদোষ যেন ওই হাতের ভঙ্গিমায় আর আন্দোলনের ছন্দে পতঙ্গবৎ এগিয়ে গিয়েছিল।