না, পারছি না। কারণ আমি মনে করি না মানুষ একটা ইট-কাঠের ঘর, যার পরিবর্তন নেই। তাছাড়া আমি তো স্বীকার করছি ভাই, ফ্রাঙ্কলি স্বীকার করছি, নন্দিতার মধ্যে আমি আর কোনো আকর্যণ খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মহৎ চরিত্র মহাত্মা নই, নেহাতই ক্ষুধা-তৃষ্ণার অধীন রক্ত-মাংসের মানুষ মাত্র, কাজেই
প্রান্তিক বোধকরি আজ ওদের সম্বন্ধে একটা হেস্তনেস্তই করতে এসেছে, তাই অন্যদিনের মতো তর্কের মাঝখানে রেগে উঠে যায় না। যদিও অন্যদিন তর্ক এতদূর গড়ায় না। প্রান্তিক তাই তীব্র গলায় বলে—মানুষ বলতে তুমি কী বোঝ, প্রদোষ?
প্রদোষ হাসির গলায় বলে, দুই চক্ষু, দুই কর্ণ, দুইখানি হাত, দুইখানি পা ও একটি ধড়বিশিষ্ট একটি জীব। আবার কি?
শুধু জীব! ওঃ—প্রান্তিক যেন ঘৃণায় চুপ করে যায়।
প্রদোষ এ ঘৃণায় বিচলিত হয় না।—প্রদোষ হেসে হেসে বলে, তবে? আমি তো তোমাদের মতো সাহিত্যিক নই, আর নিজেকে সনাতন ভারতের মহান ঐতিহ্যের ধারক বাহক বলেও দাবি করি না। অতএব কেন খামোকা জীবকে শিব ভাবতে বসব? কিন্তু আলোচনাটা বড়ো বেশি ভারী হয়ে যাচ্ছে সোম, একটু কফি খাওয়া যাক।
কফি!–প্রান্তিক ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তোমার চাকরের হাতের কফি খেতে বাসনা নেই আমার প্রদোষ, কফি থাক।
প্রদোষ হেসে ওঠে, তা গৃহিণী যখন অনুপস্থিত তখন চাকরই তো ভরসা। তিনি তো প্রায় সপ্তাহখানেক তাঁর কোন্ এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে বসে আছেন।
প্রান্তিক একটু চমকায়! প্রান্তিক বলে, বান্ধবীর বাড়িতে? কেন, ওঁর বাপের বাড়িতে নয়?
না, প্রদোষ অবহেলাভরে আর একটা সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে বলে, বাপের বাড়ি যাননি। বাপ-মায়ের অবাধ্য হওয়া লাভ-ম্যারেজের এই পরিণাম তাদের কাছে উদঘাটিত করতে নাকি ওঁর লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।
যাওয়াই তো উচিত। প্রান্তিক রুক্ষ গলায় বলে, তোমার মতোন লাজলজ্জাহীন বেহেড কে হতে পারে?
আর এতে মোটেই উদঘাটিত হচ্ছে না, কেমন? প্রদোষ ব্যতিক্ত মুখে বলে, কেউ কিচ্ছু টের পাচ্ছে না, তাই না? লজ্জা যদি তার ভিতরে থাকত, এভাবে চলে যেতে পারতেন না।
প্রান্তিক এই তিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, অভিমান আবেগ রাগ দুঃখ এসব কিছু থাকবে মানুষের?
থাকবে। থাকুক। প্রদোষের মুখে একটুকরো ধারাল হাসি ঝলসে ওঠে, অতএব লোভ মোহ বাসনা কামনা এগুলোও থাকবে। এর সবগুলোই তোমাদের এই প্রকৃতির গড়া বৃত্তি।
প্রান্তিক হতাশ গলায় বলে, তবে যাও, লোভকে জয়যুক্ত করতে ব্যাঙ্ক লুঠ করোগে। বৃত্তিগুলো আছে বলেই প্রবৃত্তির দাস হব, এটা একটা শিক্ষিত মানুষের কথা নয়, প্রদোষ! বহু যুগ ধরে মানুষ সংযমের অনুশীলন করে করে একটা সভ্যসমাজ গড়ে তুলেছে, যে সমাজের আইন আছে, শৃঙ্খলা আছে, মানবিকতা বোধের সাধনা আছে, সেই বহুদিন-সঞ্চিত সম্পদকে কোনো মূল্য দেবে না তুমি? নিজেকে চেক করতে চেষ্টা করবে না?
ওরে বাপ! প্রদোষ আবার শব্দ করে হেসে ওঠে, অনেকক্ষণ ধরে হাসে! তারপর বলে, সত্যিই তোমার উপদেশগুলো প্রায় বাবা মহারাজদের কান-ঘেঁষা হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে চেক। হাসালে সোম। কেন সে চেষ্টাটি করব বলতে পার? যাতে আমার সুখ, যাতে আমরা আহ্বাদ, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যাতে যন্ত্রণা, যাতে জ্বালা, সেটা বেছে নিতে যাব? মাপ করো ভাই, তোমাদের হিসেবমতো মানুষ হবার ক্ষমতা যদিও বা থাকতে পারে, বাসনা আমার নেই।
প্রান্তিক এবার উঠে দাঁড়ায়। প্রান্তিকের আর সহ্য হয় না। বলে, তার মানে তুমি সত্যিকার শয়তান! যদি নিজেকে সামলাবার আত্মপ্রকাশ করতে, হয়তো সামান্যতম সহানুভূতিও আসত তোমার উপর। কিন্তু তুমি জোর গলায় ঘোষণা করছ—সে ইচ্ছেই তোমার নেই। ছি ছি!
এ ছি ছি-কারে প্রদোষের মুখের একটি রেখাও এদিক-ওদিক হয় না। প্রদোষ তেমনি পাথুরে মুখেই বলে, করলাম ঘোষণা। কারণ আমি অনেস্ট।
হ্যাঁ, শুধু এইটুকুই বলে প্রদোষ। অন্যদিনের মতো বলল না, কি হে, চটে-মটে যে চলেই যাচ্ছ। বন্ধুর থেকে বন্ধুপত্নীর প্রতি দরদটাই যে দেখছি প্রবল!
বলত। অন্যদিন হলে বলত। আজকাল এই ধরনের কথাই বলছিল। বলতে পারত, মিসেস ভৌমিকের প্রতি তুমি যে-রকম সহানুভূতিশীল, তাতে আমার অনেকটা নিশ্চিন্ততা আসছে। হৃদয়রসস্পর্শের অভাবে গোলাপ গাছটি শুকিয়ে যাবে না। যে-কোনোখান থেকে একটু হৃদয়রসের স্পর্শ পেলেই কাজ চলে যায় মানুষের। ওটাই মানুষের ধর্ম। দেখতে পাও না কত ব্যক্তি নিজে বিয়ে-থা ঘর-সংসার করে না, অন্যের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে নিজেকে পরগাছার মতো জড়িয়ে রেখে দেয়! ওই থেকেই সুখ আহরণ করে। ওই থেকেই হৃদয়রস পায়। সে সংসারটি কোনো একটি তুতো বৌদির বা তুতো দিদির অথবা কোনো ভাইঝির কি ভাগ্নীর, ভাইপোর কি ভাগ্নের, বা নিঃসম্পকের হতে পারে। সব রকম পরিস্থিতিই ঘটে মানুষের। তা সে এইরকমই কোনো জীবনের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিয়েই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায় তারা। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষই যে একটা নিয়মের ছাঁচে ঢালাই হবে, তার কোনো মানে নেই। অতএব তুমিও তা না পারতে পার। আর
ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে এটুকুও বলতে পারত প্রদোষ, আর বলেইছি তো, এ বাড়ির মহিলাটি এখনও প্রেয়সী হিসেবে চার্মিং। কিন্তু এসব বলল না প্রদোষ।
তার মানে, আর এসব কথা ভালো লাগছে না ওর। তাই শুধু বলল, সত্যি কথাটা আমি স্পষ্ট করেই বলি, সোম। কারণ আমি অনেস্ট।