প্রান্তিক ব্যথিত গলায় বলে, ষোলো বছর ঘর করে, কেন এই অদ্ভুত খেয়ালটা তোমায় পেয়ে বসল প্রদোষ?
তা যে-কোনো জিনিসই একঘেয়ে লাগবার জন্যে খানিকটা সময় তো লাগেই।
প্রান্তিক রুষ্ট মুখে বলে, তোমার এই কন্দর্পকান্তিখানি তত বেয়াল্লিশ বছর ধরে দেখে আসছ, একঘেয়ে লাগছে না?
প্রদোষ যেন ওর এই রোষে আমোদ পায়। তাই প্রদোষের মুখে একটা কৌতুকের আভাস ছড়িয়ে পড়ে।
প্রদোষ বন্ধুর কথার উত্তরে বলে, এখনও পর্যন্ত তো লাগেনি। বরং আর্শির সামনে দাঁড়ালে রীতিমতো ভালোই লাগে! একঘেয়ে লাগলে সুইসাইড করে ফেলতে পারি, বলা কিছু যায় না।
থামো! বেশি কথার কায়দা দেখাতে এসো না। মিসেস ভৌমিকের দিকটা একবারও ভেবে দেখবে না তুমি?
মিসেস ভৌমিক? প্রদোষ এবার এলায়িত ভঙ্গি করে সোজা হয়ে বসে। সিগ্রেটটা অকারণেই একবার ঝাড়ে। তারপর বলে, তোমাদের মিসেস ভৌমিকের কোনো অসুবিধে ঘটাচ্ছি না আমি।
কোনো অসুবিধে ঘটাচ্ছ না?
না। অন্তত আমি তো মনে করি না ঘটাচ্ছি। তার জন্যে ঘর-বাড়ি, টাকা-কড়ি, পদমর্যাদা, সামাজিক পরিচয় সবই রইল, শুধু প্রার্থনা—অনুগ্রহ করে আমায় ছেড়ে দিন। আমার ওপর যেন না সেই পুরনো প্রেমের ট্যাক্স বসাতে আসেন।
পুরনো প্রেম? বলতে লজ্জা করল না প্রদোষ?
লজ্জা? কই, করছে না তো! বরং এইটাই ভেবে লজ্জা করছে, যে ভালোবাসা আর নেই, যা কালের বাতাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তিনি সেইটার জন্যে হ্যাংলামি করছেন। অথবা সেইটার অভাবে রাগারাগি করছেন।
প্রান্তিক ওই নির্মম মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, প্রদোষ, তোদের বিয়ের কথাটা তোর মনে পড়ে না?
প্রদোষ বঙ্কিম হাসি হেসে বলে, সেন্টিমেন্টে আঘাত হানছ? কিন্তু বন্ধু হে, আমি তোমার গল্পের নায়ক নই যে, সহসা একটি কথার আঘাতে মুহূর্তে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যাবে। আমি হচ্ছি রক্তমাংসে গড়া বাস্তব মানুষ। আমি বুঝি ফঁকা আইডিয়ার চরণে জীবনকে অর্ঘ্য দেওয়াটা প্রকাণ্ড একটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, একদা আমি শ্রীমতী নন্দিতার জন্যে পাগল হয়েছিলাম। তাকে পাবার জন্যে বাড়িতে অপ্রিয় হয়েছিলাম, ওদের বাড়িতেও প্রায় অপমানিত হয়েছিলাম, তারপর ওকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেজিস্ট্রি করে এসে উভয় পক্ষের অভিভাবকের মুখ চুন করে দিয়েছিলাম। এবং তারপরে বেশ কিছুকাল ধরে প্রায় স্বর্গসুখে ভেসেছিলাম, এ সবই আমার মনে আছে। ভুলিনি কিছুই। শুধু সেই স্বর্গ আর এখন স্বর্গ বলে মনে লাগছে না।
প্রান্তিক উঠে দাঁড়ায়। ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তা তো লাগবেই না। কারণ তুমি এখন নতুন স্বর্গ আবিষ্কার করেছ! তাই না?
প্রদোষ আবার হো হো করে হেসে ওঠে, হাসির গলাতেই বলে, স্বর্গ কি নরক তা জানি না, তবে আপাতত স্বর্গ স্বর্গই লাগছে। কিন্তু প্রান্তিক, সত্যি বল, তার জন্যে আমি নন্দিতাকে কিছু অসুবিধেয় ফেলেছি?
অসুবিধেয় ফেলেছ কিনা জিজ্ঞেস করছ? প্রান্তিক ব্যঙ্গের গলায় বলে, তার মানে, তোমার ধারণায় ফেলনি অসুবিধেয়?
অফকোর্স? আর সে ধারণাটা আমার ভুল নয়। নন্দিতাকে আমি বলতে গেলে সর্বস্ব দিয়ে রেখেছি। ব্যাঙ্কে আমাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট, অতএব যখন ইচ্ছে, যখন দরকার, টাকা তুলে নিতে পারছে, ভাড়া দেওয়া বাড়িটা ওর একাকার নামে, কাজেই ভাড়াটের ছশো টাকা ওর নিজস্ব, সারা সংসারের চাবি ওর হাতে, ছেলেটা মানুষ হচ্ছে ওরই ইচ্ছানুযায়ী, কোথাও কোনোখানে আমার ইচ্ছের অঙ্কুশ আঘাত করছে না তাকে। আর কি করতে পারি বল? ওর থেকে আর বেশি কিছু করার নেই আমার।
প্রান্তিক গাঢ় গলায় বলে, কিন্তু আগে এ-সবের ওপরে এর থেকে বেশি, অনেক বেশি কিছু করবার ছিল তোমার প্রদোষ! করেওছ। এই বস্তুপুঞ্জটাকেই সর্বস্ব বলে মনে করনি। আরও কিছু দিয়েছ।
প্রদোষ উদাস গলায় বলে, তখন যা দেবার ছিল এখন তা নেই। এছাড়া আর কোনো বক্তব্য নেই আমার।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার একই কথা বলে প্রদোষ। নন্দিতাকে সে কিছুমাত্র অযত্ন করছে না, বরং যতদূর সম্ভব সুখে-স্বচ্ছন্দে রাখতে চেষ্টা করছে। নন্দিতাকে পূর্ণমাত্রায় স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে, নন্দিতার গতিবিধি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করছে না, ইত্যাদি।
প্রান্তিক তবু চেষ্টা করছে। সে যেন ওদের লঘু একটু দাম্পত্য কলহ মিটিয়ে দিতে এসেছে, তাই সে বলে, অথচ আগে? মনে আছে তোমাদের, প্রদোষ? মিসেস ভৌমিক যদি একদিনের জন্যে বাপের বাড়ি যেতেন, তুমি ছটফট করতে, রাগারাগি করতে রাতদুপুরে সেখানে গিয়ে হাজির হতে, নিয়ে চলে আসতে। ব্যাপারটা প্রত্যেকবারই এমন মহাভারত হয়ে উঠত যে, সে-সব এখন ভুলে গেছি বললে অবিশ্বাস্য হবে।
প্রদোষ উঠে দাঁড়ায়, ঢিলে পায়জামার ঢিলে পকেটে হাত দিয়ে পায়চারি করতে করতে বলে, একদা আমি হামা দিতাম, সোম! আর একদা সিগারেট খেতে গেলেই কাশতাম। বুঝলে? আশ্চর্য, তুমি একটা নভেল-লিখিয়ে ব্যক্তি অথচ কিছুতেই কেন বোঝাতে পারছি না তোমাকে—যা ফুরিয়ে গেছে, তা দেব কোথা থেকে? তবে এর জন্যে নিজেকে আমি খুব একটা পাষণ্ড ভাবতে পারছি না–
ভাবতে পারছ না?
প্রান্তিক উত্তেজিত গলায় বলে, তুমি একটা বিবাহিত ব্যক্তি, একটা তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলের বাপ তুমি, হঠাৎ তোমার ভালোবেসে-বিয়ে-করা, আর এতদিনের-ঘর-করা স্ত্রীকে বলছ আমরা ওপর দাবি ত্যাগ কর কারণ আমি এখন পরকীয়া প্রেমে মেতেছি। তবু তুমি নিজেকে পাষণ্ড ভাবতে পারছ না?