আর এও বিশ্বাস হয় না, রান্নার বই দেখে দেখে নতুন রান্না করে স্বামী-পুরকে খাওয়ানোর জন্যে দুপুরের বিশ্রামের হাতছানিকে আমল দিত না।
এ যেন আর এক নন্দিতা। লজ্জা-সরম বিবর্জিত, শালীনতা-অশালীনতা বিসর্জিত একটা প্রতিহিংসা-সাধনের যান্ত্রিক মূর্তি।
৪. আবার একদিন প্রান্তিক এল
আবার একদিন প্রান্তিক এল। বলল, প্রদোষ একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। দপ করে জ্বলে ওঠে নন্দিতা, দেখা! আমার সঙ্গে! মানে?
মানে হচ্ছে—বলছিল টুবলুকে কোনো বোর্ডিংয়ে ভর্তি করে দেওয়া দরকার কি না সেই পরামর্শ করতে।
পরামর্শ? আমার সঙ্গে? নন্দিতা ধারালো গলায় বলে, ন্যাকামিরও একটা সীমা থাকে, প্রান্তিক! কিন্তু দেখছি তোমার এই নির্লজ্জ বন্ধুটির কোথাও কোনোখানে সীমা নেই।
প্রান্তিক মিটমাটের সুরে বলে, বন্ধুর হয়ে আমি কিছু বলতে আসিনি নন্দিতা, আর তোমরা দুজনেই আমার বন্ধু। আজ থেকে নয়। কিন্তু সে কথা যাক, ও বলছিল, চিরদিনই তো ছেলেটাকে তার মায়ের বিজনেস বলে ভেবে এসেছি, তাই ওর সম্পর্কে কি করা সঙ্গত বুঝতে পারছি না।
নন্দিতা এ কথায় গলে না। নন্দিতা তীব্রস্বরে এইটুকুই জানিয়ে দেয়—প্রদোষ ভৌমিক খোকা নয়, আর তার ছেলেও খোকা নেই। নন্দিতার কোনো বিজনেস নেই। নন্দিতা ধরে নিয়েছে ত্রিভুবনে তার কেউ নেই, সে কারও নয়।
প্রান্তিক বিষণ্ণ হয়ে বসে রইল একটু। প্রান্তিকের মনে ক্ষীণ একটু আশা জাগছিল, ছেলের প্রশ্ন নিয়ে হয়তো একবার ওরা মুখোমুখি হবে। আর সেই মুখোমুখির ঘটনাতেই হয়তো সমস্ত পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যাবে। জগতে এমন ঘটনা ঘটে বৈকি। দুরন্ত রাগ, দুর্জয় অভিমান, হঠাৎ হয়তো একবার কাছাকাছি আসার সূত্রে ভেঙে যায়, গলে যায়। একটু নির্জনতায়, একবার চাহনিতে যে কী হয়, কী না হয়!
কিন্তু প্রান্তিকের আশা রইল না। নন্দিতা যেখানে দেখা করতে চাইল, সেখানে হৃদয়-সমস্যার সমাধান হয় না। তবু নন্দিতা সেই স্থানটাই নির্বাচন করল। বলল, বোলো দেখা করব। কোর্টে। তার আগে নয়।
.
প্রদোষ হেসে বলল, কী হে ভগ্নদূত, দেখলে তো? বলিনি? চিনি তো মহিলাকে!
প্রান্তিক রুক্ষ গলায় বলে, এমন ছিল না ও প্রদোষ, তুমিই করে তুলেছ।
অস্বীকার করছি না। যাক, আমি আর টুবলুর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাব না। ইচ্ছে হয় স্কুলে যাবে, না হয় স্কুলে যাবে না। রাস্তার রকবাজ ছেলে হয়ে ঘুরে বেড়ানোই যদি ওর, তোমরা গিয়ে কি বলে, নিয়তি হয়, তাই হবে।
তাই হবে? প্রান্তিক রুক্ষগলায় বলে, আর তুমি সে দৃশ্যের দর্শক হয়ে দার্শনিক-সুখ অনুভব করবে?
উপায় কি? প্রদোষ অবহেলাভরে ধোঁয়ার রিং সৃষ্টি করতে করতে বলে, সুদপদেশ দিতে গেলে নেবেন বাবু? জানো, ও আমার সঙ্গে কথাই বলে না। কোনো একটা প্রশ্ন করলে দশবারে উত্তর দেয়। আর যখন দেয় বা যেটা দেয়, মনে হয় তার থেকে একটা চড় বসিয়ে দিলেও অনেক কম অপমানিত হতাম। রাতদিন খোকামি করে বেড়াত, চকলেটের জন্যে বায়না করত, জামা-জুতোর ঠিক রাখতে পারত না। অথচ এখন দেখছি একটি বিষধর সপশিশু!
প্রান্তিক ওর ক্ষুব্ধ মুখের দিকে তাকায়। প্রান্তিকের সহানুভূতি আসে না। প্রান্তিক রুক্ষ গলাতেই বলে, স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক? হুঁ, সবাইয়ের সব কিছুই স্বাভাবিক, শুধু একটা মানুষ যদি কোনোখানে একটু জীবনের রস অন্বেষণ করতে চায়, সেটাই বিশ্বছাড়া অস্বাভাবিক। কি বল? প্রদোষ বাঁকা গলায় বলে, কি হল? ভালো বাংলা বললাম না?
প্রান্তিক রুদ্ধগলায় বলে, উচ্ছন্নে যাও তুমি।
আহা, সে আর নতুন করে কী যাব? গিয়েই তো বসে আছি। শুধু ভাবছিলাম তুমি যদি শ্ৰীমতী নন্দিতার এই দুঃসময়ে তাকে একটু হৃদয়রসস্পর্শ জোগাতে পারতে, বিবেকের দংশনটা একটু কম অনুভব করতাম।
প্রান্তিক তীব্রস্বরে বলে, আর কোর্টে গিয়ে বলবার মতো দুটো কথাও পেতে।
প্রদোষ হেসে ওঠে। হা হা করে অস্বাভাবিক হাসি।
তারপর বলে, তোমাদের সাহিত্যিকদের এই এক দোষ, বড়ো তাড়াতাড়ি ভিতরের কথা বুঝে ফেল।
হঠাৎ ধমাস করে একটা শব্দ হয়।
এরা দুজনেই চমকে ওঠে।
তারপর লক্ষ করে বসবার ঘর আর টুবলুর পড়বার ঘরের মাঝখানে যে দরজাটা রয়েছে, টুবলু সেটা যতটা সম্ভব জোরে বন্ধ করে দিয়েছে। এটা তারই শব্দ।
প্রদোষ তিক্ত হাসি হেসে বলে, দেখলে তো? এই ছেলেকে আমি আহা মাতৃহীন বলে পিঠে হাত বোলাতে যাব?
.
না, টুবলুর পিঠে হাত বোলাতে যাবার সাহস শুধু তার অপরাধী বাপেরই নেই তা নয়, কারোরই নেয়। মাসি একদিন ডেকে পাঠিয়েছিল, হয়তো ওই পিঠে হাত বোলাবে বলেই, টুবলু যায়নি। অতঃপর মাসিই একদিন এল। পিঠ পর্যন্ত নিয়ে গেল হাত, বলল, চ না তোতে আমাতে তোর হাড়মুখ মা-টার কাছে যাই। দেখি তোকে দেখে কেমন মুখমি বজায় রাখতে পারে!
কিন্তু টুলু সে হাতকে আর অগ্রসর হতে দিল না। টুবলু ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর মাসিকে একটা কথাও না-বলে গট গট করে বেরিয়ে গেল।
এরপর আর কার কাছে বসে থাকবে মাসি? কত আর অপমান সইবে? গজগজ করতে করতে চলে গেল, শনি, শনি ঢুকেছে বাড়িতে! সব কটার বুদ্ধিবৃত্তি ভব্যতা-সভ্যতা হরে নিয়েছে। নইলে—এই বাড়িই এই সেদিন পর্যন্তও ইন্দ্রভবন লেগেছে। আর এই সেদিনও ওই ছেলে মাসি একটা গল্প বল না বলে কাছ ঘেঁষে বসেছে।