ঘর? নন্দিতাও এবার একটা ক্ষুব্ধ হাসি হাসে। নিজে ভেঙে গুঁড়ো করছি না প্রান্তিক, ভেঙে ধ্বসে পড়ছে দেখে ছাদ-চাপা পড়ে সমাধি হবার পরিণাম এড়াতে পালিয়ে এসেছি। ঘর? ঘরের মূল্য তোমরা কতটুকু বোঝ? ঘর মেয়েদের জীবনের কতখানি তা জান?…বই লেখ বলেই সব বুঝে ফেলেছ তা ভেব না। তবু সেই ঘর যখন কোনো মেয়ে স্বেচ্ছায় ছেড়ে আসে, জেনো অনেক দুঃখেই আসে। তবু এও জেনো, ঘর যতই মূল্যবান হোক, আত্মসম্মানের থেকে বড়ো নয়। যদি তোমার মহৎ নায়িকারা তাকে সে প্রাধান্য দেন তো বুঝব হয় তাদের আত্মসম্মানবোধই নেই, নয় তাদের ওই ইট-কাঠের ঘরটার ওপরই নির্লজ্জ লোভ। তুমি আর আমায় সুবুদ্ধি দিতে এস না প্রান্তিক, কে আমি করবই। ওকে আমি কোর্টে দাঁড় করাবই।
প্রান্তিক হার মেনে ফিরে গেল। শিখা তো আগেই হার মেনেছিল। তবু সুমতি দিতে আসবার লোক আরও ছিল বৈ কি! নন্দিতা একটা বড়ো সংসারের মেয়ে তো বটে।
নন্দিতার দিদি এল গোড়ায়, বলল, তিলকে তাল করিসনে নন্দি, ইচ্ছে করে লোক হাসাসনি। প্রদোষের অধঃপতনে যদি বা লোকের তোর ওপরে সহানুভূতি আসছিল, তোর এই মামলা করার কেলেঙ্কারীতে সে সহানুভূতি ঘুচবে।
লোকের সহানুভূতি? নন্দিতা ব্যঙ্গ হাসি হাসল, জিনিসটা একদম অসার দিদি, কিছুমাত্র ফুভ্যালু নেই।
তা যাক, মা-বাবার মুখটার দিকেও চাইবি না? একবার তো বিয়ের সময় যথেষ্ট মুখ পুড়িয়েছিলি, আবার সেই সাধের বিয়ের কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে
নন্দিতা গম্ভীর হয়। নন্দিতা সেই গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে, দেখ দিদি, মুখ যদি তারা পুড়ছে কল্পনা করেই পোড়ার জ্বালা অনুভব করেন, আমার কি করবার আছে? ছেলেমেয়েরা বড়ো হলে যে তারা আর তাদের শিশুটি থাকে না, পুরো একটা মানুষ হয়ে ওঠে, তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, সমস্যা-প্রতিকার তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়, এগুলো মা-বাবারা ভুলে যান বলেই এত জ্বালা। আমার ভালোবাসাকে তাঁরা সমর্থন করেননি, বিয়ের সময় অকারণ প্রতিকূলতা করে অনেক কষ্ট দিয়েছেন আমায়, তারপর শুধু শুধুই কতকাল নির্লিপ্ত থেকেছেন, ঠেলে রেখেছেন, সে তো তোমার অজানা নয়! বলতে গেলে তোমার চেষ্টাতেই আবার তারা আমাকে মেয়ে বলে স্বীকার করেছিলেন, নচেৎ হয়তো করতেন না। এখনও আমার জীবনের এই সমস্যার দিকে তারা সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। জামাইকে নিন্দেমন্দ করলেও, তার দোষটাকে ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে করছেন না, ভাবছেন আমিই অসহিষ্ণু। আমিই বা তবে তাঁদের মুখের কথা ভাবতে যাব কেন?
দিদি হতাশ হয়ে বলেন, তবে আর কি বলব। তবে টুবলুর কথাটাও একবার ভাবলে পারতিস!
ভেবেছি।
নন্দিতা তীব্র গলায় বলে, তার সম্পর্কে বেশি ভাবনা না-করলেও চলবে। সে ঠিকই সাপের তেলে সলুই হচ্ছে। সেও তার বাপের মতো আমায় আসে ধমকাতে, চুপ করাতে।
তা তোরা রাতদুপুরে পাড়া জানিয়ে ঝগড়া করবি—সে ছেলেমানুষ, মা ছাড়া জানত না—
দিদি থাম। ভয়ানক মাথা ধরেছে। মোটেই আর সে ছেলেমানুষ নেই। আমার জন্যে তার কিছুই এসে যাবে না। বাপের পয়সা আছে, চাকর-বাকর আছে, ইচ্ছে হলে বোর্ডিংয়ে পাঠাবে, দু-দিন বাদে বিলেত পাঠাবে, মিটে যাবে সমস্যা।
তাহলে বলতে হবে তোর সেই মাতৃস্নেহটাও মিথ্যে ছিল।
নন্দিতা মুখটা অন্যদিকে ফেরায়। নন্দিতা ঘাড় ফিরিয়ে বলে, তাই ছিল তাহলে। তবে—এটা জেনো, আমার কাছে স্নেহ প্রেম সব কিছুর বড়ো আমি যে একটা মানুষ, সেই চেতনাটুকু।
অতএব লড়াই বাধে।
একদিন মা এসে মাথার দিব্যি দিয়ে যান, বাপ এসে অভিসম্পাত, তবু বাধে।
পিসি-মাসি দাদা-বৌদি এবং আরও অনেকেই আসেন, শেষ অবধি রাগ করে ফিরে যান। কারণ নন্দিতা আপন সংকল্পে অটল।
শিখার বাড়িতেই রয়ে গেছে নন্দিতা, তাই শিখা আর সাহস করে বেশি কিছু বলে না, কি জানি বন্ধু যদি আহত হয়। যদি বলে আমাকে ভারস্বরূপ লাগছে বলেই বুঝি সেই নোংরা লোকটার সঙ্গে মিটমাট করতে বলছ?
আসল কথা নিয়তি। ওর বাড়া অমোঘ, ওর বাড়া অনিবার্য আর কি আছে? নন্দিতার এই নিয়তি, তাকে রোধ করবে এ সাধ্য কি নন্দিতার আছে? নেই।
তাই নন্দিতা অসাধ্য সাধন করে বেড়ায়! নন্দিতা উকিলবাড়ির মাটি নেয়, নন্দিতা পড়ে পড়েই বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন মুখস্থ করে ফেলতে বসে।
কিন্তু জায়গায় জায়গায় খটকা লাগছে। নিজের দিকে যেন উপকরণ কম। উকিল বলছে, শুধু স্বামী অনাসক্ত, অথবা আপনার প্রতি উদাসী, এটুকুতে কাজ হবে না। সলিড় কিছু চাই। প্রমাণ করতে হবে মিস্টার ভৌমিক চরিত্রহীন।
প্রমাণ!
নন্দিতা ঝঙ্কার দিয়ে বলে, তার গতিবিধিই তার প্রমাণ।
ওতে হয় না। উকিল কুটিল হাসি হাসেন, আরও কিছু দরকার।
অতএব সেই দরকারি বস্তুটা নির্মাণ করতে বসেন উকিলবাবু। নন্দিতাকে বাঁশ-দড়ি খড় মাটির জোগান দিতে হয়।
মিছে কথা? কে বলেছে মিছে কথা? নন্দিতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে এইটুকুই হয়তো বানানো, তাছাড়া? তবু খারাপ লাগে বৈকি! নিজেকেই যেন ক্লেদাক্ত মনে হয়, অশুচি মনে হয়। কিন্তু উপায় কি? নাচতে নেমে. তো ঘোমটা চলে না। প্রত্যক্ষদর্শীর মহিমা নিতে হলে যা মুখস্থ করবার, করতে হবে বৈকি। দিনরাত্তিরের চিন্তাতেই তাই লেগে থাকে একটা ক্লেদাক্ত অনুভূতি।
বিশ্বাস হয় না, কিছুদিন আগেও এই নন্দিতা প্রত্যেকটি বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর ঘট সামনে দিয়ে ধূপ-ধুনো ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করতে বসত। বিশ্বাস হয় না, পাজী দেখে নীলষষ্ঠী মহাষ্টমীর দিন বরের কাছে বায়না করত—গাড়িটাকে চালিয়ে একটু এগিয়ে নিয়ে চল দিকিনি, একটু বড়ো গঙ্গায় স্নান করে আসি। এখানের ঘাটে যা কাদা, নামতে ইচ্ছা করে না।