আর প্রান্তিক সোমই সে ছেলেকে লায়েক করে তোলায় সক্রিয় সাহায্য করেছে।
ওদের সুখ যেন প্রান্তিকেরও সুখ, ওদের প্রেম যেন প্রান্তিকেরই গৌরব। অন্য অন্য বন্ধুদের কাছে কত সময়েই প্রান্তিক তার বন্ধু-দম্পতির নিটুট নির্ভেজাল প্রেমের উদাহরণ দেখিয়েছে, সে গৌরব-মন্দির সহসা ধূলিসাৎ হয়ে গেল প্রান্তিকের।
তাই প্রান্তিক এক বন্ধুর কাছে আবেদন করে ব্যর্থ হয়ে আর-এক বন্ধুর শুভবুদ্ধির দরজায় আবেদন করতে আসে। আধুনিক লেখক হয়েও তার যুক্তিটা সেকেলে। নইলে বলে কিনা—বুঝলাম তো সবই, কিন্তু মনে রাখতে হবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে–তুমি হচ্ছ মা।
নন্দিতা ওর এই সেকেলে ভাবপ্রবণতাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে বলে, রাখ তোমার ওই পচা কথা, ওই মিথ্যে সেন্টিমেন্টের বেড়ি পায়ে পরিয়ে রেখে চিরটাকাল তোমরা মেয়েদের নিরুপায় করে রেখেছে। এই কেস-এর ব্যাপারে তুমি যদি কোনো সাহায্য করতে পার তো এসো এখানে, নচেৎ তোমার সেই শয়তান বন্ধুর কাছে বসে বসে সিগারেট ওড়াওগে। বলছ কি করে যে, এরপরে আবার আমি ওর ঘরে ফিরে যাব, আবার ওর স্ত্রীর পরিচয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াব!
প্রান্তিক ম্লান হাসে। বলে, এর চেয়ে অনেক বেশি নারকীয় পুরুষের স্ত্রীর পরিচয় নিয়েও অনেক মেয়েকে ঘুরে বেড়াতে হয়, নন্দিতা!
হ্যাঁ, কখনও বলে মিসেস ভৌমিক, কখনও বলে নন্দিতা। আজ ইচ্ছে করে নন্দিতাটাই ব্যবহার করছে। কল্যাণকামী বড়ো ভাইয়ের গলায় কথা বলছে। সেই গলাতেই বলে, এর থেকে অনেক বেশি নারকীয় পুরুষের স্ত্রীর পরিচয় নিয়েও অনেক মেয়েকে ঘুরে বেড়াতে হয় নন্দিতা! কারণ মেয়েরা স্বভাবতই ক্ষমাশীল।
ওর ওই নতুন প্রেমের নায়িকার চুনকালি-মাখা মুখটা একবার দেখুক ও।
চুনকালি?
প্রান্তিক বিষণ্ণ হাসি হাসে, তুমি কি জান নন্দিতা, কতটা চুনকালির সঞ্চয় থাকলে তবে এদের মতো চরিত্রের মুখে চুনকালি মাখানো যায়? দেখবে তোমার এই আত্মসম্মান তখন আত্মহত্যার পথ খুঁজতে চাইবে।
ওঃ তোমার মতে আইনটা কেউ কাজে লাগাচ্ছে না?
লাগাবে না কেন, লাগাচ্ছে। হয়তো অনেকেরই অন্য প্রয়োজন আছে। কিন্তু তুমি নন্দিতা, তুমি কি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে?
রক্ষে কর! জীবনে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
তবে? তবে শুধু আপাতত সেপারেশনটাই থাক না! তাতে অন্তত–
নন্দিতা রূঢ় গলায় বলে, ওঃ, তুমি বুঝি ওর চর হয়ে এসেছ? অথবা ওর উকিল? যাতে ওর সব দিক রক্ষে হয়, সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি অক্ষুণ্ণ থাকে, অথচ নতুন প্রেমের পানসিটিও ভাসে, তার ব্যবস্থাতেই? আমি ওর প্রতিষ্ঠা ঘোচাব, এই হচ্ছে আমার শেষ কথা।
তা শেষ কথার পরও অনেক কথা বলে প্রান্তিক, অনেক শুভ প্রেরণা দিতে চেষ্টা করে। ছেলের মুখ চাইতে বলে, মা-বাপের মুখ চাইতে বলে, কিন্তু নন্দিতাকে সংকল্প থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না।
নন্দিতা বলে, একদিনে অসহিষ্ণু হইনি প্রান্তিক, একদিনে এ সঙ্কল্প করিনি। ধৈর্যের শেষ সীমায় পোঁছে তবেই—ও যদি সাধারণ চরিত্রচ্যুত লোকের মতো লুকোচুরি করত, আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলত অথবা ধরা পড়ে গেলে ঘটনাটাকে অস্বীকার করত আমি হয়তো ক্ষমা করতে পারতাম। সেখানে দুর্বলচিত্ত পুরুষের বাঁদরামি বলে উড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু ও তা করেনি। ও দিনের পর দিন আমার মুখের ওপর বলেছে, তোমাতে আমার আর রুচি নেই। বলেছে, আমাকে তুমি রেহাই দাও। দেব রেহাই! তবে ওর ইচ্ছেমতো ওর সংসারের গিন্নি সেজে বাঁদীগিরি করে নয়।
তবু প্রান্তিক ক্ষমার কথাই তোলে। বলে, মেয়েরা ক্ষমাপরায়ণা।
সে তোমার উপন্যাসের মহৎ নায়িকারা প্রান্তিক, রক্তমাংসের মানুষ মেয়েরা নয়। ক্ষমা? ক্ষমা মানুষ কাকে করে? অনুতপ্তকে, ক্ষমাপ্রার্থীকে। বল তাই কিনা? একটা নির্লজ্জ জানোয়ারকে ক্ষমা করতে যাব আমি?
কিন্তু চিরদিন সে জানোয়ার ছিল না, নন্দিতা! আজ শুধু সাময়িক একটা বিভ্রান্তি তাকে এমন করে তুলেছে!
থাম, তোমার ও-কথা বিশ্বাস করি না আমি। এখন বুঝছি চিরকাল ও আমায় ঠকিয়েছে। হা এই চিন্তাতেই ক্ষেপে গেছে নন্দিতা। চিরকাল ঠকিয়েছে! আমায় সরল পেয়ে ধাপ্পা দিয়ে দিয়ে চালিয়েছে, আর আমি চোখে মায়ার কাজল পরে বসে বসে ঠকেছি। ছি ছি! আবার আমি সেই ভুলের সুখকে বুকে ভরতে যাব? গলায় দিতে দড়ি জুটবে না আমার।
প্রান্তিক ক্ষুব্ধ গলায় বলে, তোমার এটা ভুল ধারণা, নন্দিতা! আমি বলছি এটা সাময়িক। বলতে পার এ একটা ব্যাধির মতো অকস্মাৎ এসে পড়েছে। তুমি তোমার স্বামীর সেই ব্যাধির কালে চিকিৎসার চেষ্টা না-করে তাকে ত্যাগ করে চলে এসেছ, চিরদিনের মতো ত্যাগ করতে চাইছ।
কী করব বল? নন্দিতা কঠিন গলায় বলে, আমি পাপিয়সী। আমি তোমার ওই কুৎসিত ব্যাধিগ্রস্ত বন্ধুকে নার্সিং করে সারিয়ে তুলতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করছি। তবে উদাহরণটা যুক্তি নয় প্রান্তিক, আত্মপ্রবঞ্চনাটা সত্য নয়। বল তো তুমি এক্ষেত্রে তোমার গল্পের নায়িকাকে দিয়ে কী করাতে? এই অপমান-শয্যাতেই ফেলে রাখতে তাকে? আর গালভরা গলায় উপদেশ দিতে, সকলের ওপর তুমি মা! বলতে—তোমার স্বামীর হঠাৎ একটি ছোঁয়াচে অসুখ ধরেছে, তুমি তাকে নার্সিং করে সারিয়ে তোলো?..বল? বল শীগগির বলতে পারবে না, উত্তর নেই।
প্রান্তিক আরও ক্ষুব্ধ গলায় বলে, জীবনকে গল্পের নায়িকার ছাঁচে ফেলতে যাওয়ায় সুখ নেই, নন্দিতা! তোমরা দীর্ঘ ষোলোটা বছর পরস্পরের সুখে-দুঃখে জড়িত হয়ে যে ঘরটা গড়ে তুলেছ, এক মুহূর্তের অসহিষ্ণুতায় সে ঘরটা ভেঙে গুঁড়ো করবে?