কাজেই চারুতোষ যদি রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে দেখেও তার বাড়ির সন্ধ্যার অতিথি দ্বিতীয় আবির্ভাবে আবার মধ্যরাতের অতিথি হয়েছে, শানানো ছুরি নিয়ে অথবা জিভে ছুরি শানিয়ে তেড়ে আসবে না।
তবু ঘোষণাটা করে গেল বিপাশা। হয়তো সত্যিও নয়, হয়তো গাড়ির শব্দ পায়নি, তবু এইভাবেই খুঁটি চালে বিপাশা।
খানিকটা পরে যখন কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে ফিরে এল বিপাশা, তখন ঘরের উষ্ণ বাতাস মিইয়ে গেছে। প্রদোষ সেই মিয়োনোর প্রতীকের মতো বসে আছে পাইপটা ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে।
প্রদোষ হাত বাড়াল চট করে, শুধু সোজা হয়ে বসল, বলল, মুখে যতই সাহস দেখান, আসলে আপনি একটা ভীরু মহিলা।
ভীরু? বিপাশা একটু বাঁকা হাসি হেসে বলে, কে? আমি?
নিশ্চয়।
তা বেশ। ভীরুই। নিন, এখন এটা খান।
দিন—হাত বাড়িয়ে পেয়ালাটা ধরে প্রদোষ, তার সঙ্গে পেয়ালাধরা হাতটাও। বলে, যতটুকু লাভ। নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক।
বাকির কোনো খাতাই নেই! বিপাশা বলে গম্ভীর গলায়।
প্রদোষ হাতটা ছেড়ে দেয়। বলে, রাগ করলেন তো?
সেই তো মুশকিল, আপনারা চির-রহস্য। বোঝা যায় না কোন্টা আপনাদের সত্যি, আর কোষ্টা তামাশা। কোন্টা পছন্দ করছেন, কোন্টা পছন্দ করছেন না।
ওঃ, সব কিছুই বুঝে ফেলতে চান? খুব সাহস তো!
নাঃ, সাহস আর কোথায়? প্রদোষ হতাশ গলায় বলে, ঠিকই বলেছেন, ভীরু আমি। ভালো ভালো নভেলের নায়করা কখনও আমার মতো এমন অনুকূল অবস্থাকে অপচয় করে না।
বিপাশা হঠাৎ ভারী ঘরোয়া বৌয়ের সুর আনে গলায়। বলে, নভেলের কথা নভেলেই মানায়।
প্রদোষ কফির পোয়ালাটা হাত থেকে নামায়। প্রদোষের চোখের কোণায় আগুন জ্বলে ওঠে। কেন, শুধু নভেলেই বা মানাবে কেন? নভেলের বাইরেই বা মানাবে না কেন? মানুষকে নিয়েই তো নভেল।…
তা হোক, বিপাশা তার গলায় সেই ঘরোয়া সুরটাই বজায় রাখে, তবু একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না, অবস্থা অনুকূল হলেই মানুষ পশু হয়ে উঠে বন্ধুর বিশ্বস্ততা নষ্ট করে তার স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, অথবা মেয়েরা সুযোগ, অথবা বলা যেতে পারে কুযোগ, জুটলেই এক মুহূর্তে সততা সভ্যতা পবিত্রতা, সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে বসতে পারে! অথচ, আপনাদের ওই আধুনিক সাহিত্যের পাতা খুললেই এই সব ঘটনা।
বলে, এই রকম সুন্দর আর সৎকথা মাঝে মাঝেই বলে বিপাশা, শুধু ওর গলার সুরের সঙ্গে চোখের কটাক্ষের মিল থাকে না।
এখনও রইল না।
প্রদোষ ওর কটাক্ষের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বলে, তার কারণ হচ্ছে আধুনিক লেখকেরা ধরে ফেলেছে আসল মানুষটা হচ্ছে ওই। সভ্যতা নামের একটা আবরণ চাপিয়ে সেই আসল মানুষটাকে চাপা দিয়ে দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।
তাহলে আর আসল মানুষটা বলছেন কেন? বলুন আসল জানোয়ারটা!
প্রদোষ হেসে ওঠে। তা, তাও বলতে পারেন। পোশাক-পরিচ্ছদ ঢাকা এক-একটা জানোয়ারই। মানুষ যে তার ওপর দেবত্ব আরোপ করতে চায়, সেটা হচ্ছে কবির কল্পনা। এই আমি এই মুহূর্তে জানোয়ার হয়ে উঠতে পারি।
ওরে সর্বনাশ! চোখের কোণে বিদ্যুৎ খেলিয়ে বিপাশা ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলে ওঠে, তাহলে তো আত্মরক্ষার্থে সরে পড়াই উচিত।
বলে, কিন্তু সরে পড়ে না। আর তার নিরুদবিগ্ন মুখচ্ছবি দেখে মনেও আসে না আত্মরক্ষার গরজ তার বিন্দুমাত্রও আছে।
এক চোখে প্রশ্রয়, আর-এক চোখ শাসন নিয়ে সে যেন এক অভিনব খেলার মজা উপভোগ করে বসে বসে। আর হয়তো মানুষ যে জানোয়ার, প্রদোষের এই কথাটার প্রমাণপত্রের অপেক্ষা করে। এবং অপেক্ষায় হতাশ হলে ভাবে…ভীরু, ভীরু! পুরুষ জাতটাই এক নম্বরের ভীরু!… চারুতোষটাকে অমানুষ ভাবি, কোন্টাই বা মানুষ? অথবা জানোয়ার?
৩. প্রান্তিক সোম টেবিল ছেড়ে
প্রান্তিক সোম টেবিল ছেড়ে অস্থির হয়ে উঠে পড়ল। লেখা আসছে না। কতদিন থেকেই আসছে না। প্রদোষ আর নন্দিতার জীবনে অশুভ গ্রহের ছায়াপাত প্রান্তিক সোমকেও বিপর্যস্ত করছে।
না, এই অবস্থাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না প্রান্তিক। কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছে না, প্রদোষ আর নন্দিতা চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
নন্দিতার সেই সংসারটি, যার কেন্দ্রবিন্দুটিতে নন্দিতা ছিল স্থির, উজ্জ্বল দীপ্তিময়ী, যেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই যেন হৃদয়ের আশ্রয় মিলত, একটি নির্মল কল্যাণের স্পর্শ পাওয়া যেত, সেখানে আর নন্দিতাকে দেখা যাবে না কোনোদিন। নন্দিতা নিজেকে সেখান থেকে উপড়ে নিয়ে যে একটা ভয়াবহ গহুর সৃষ্টি করে দিয়ে এসেছে, সেটাই শুধু চিরদিন হাঁ করে গ্রাস করতে আসবে তার সংসারের অতিথিদের, বন্ধুদের।
কেন, নন্দিতা এই ভয়াবহতার নায়িকা হয়েই বা থাকবে কেন? প্রদোষ উচ্ছন্নে গেছে বলে সে-ও যাবে উচ্ছন্নে?
প্রান্তিক যেন ক্রমশ নন্দিতার ওপরই ক্রুদ্ধ হচ্ছে। যেন নন্দিতা ইচ্ছে করলেই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। আর সে ইচ্ছে নন্দিতার করাই উচিত। শুভবুদ্ধিকে ঠেলে রেখে অশুভ বুদ্ধির বশে চলবে কেন নন্দিতা?
প্রান্তিক সোম অতএব নন্দিতা ভৌমিকের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করতে আসে। কারণ নন্দিতাও তার বন্ধু। বন্ধুর বৌ হবার আগে থেকে বন্ধু।
প্রন্তিক সোমই ওদের বিবাহের ঘটক, বিবাহের সাক্ষী। বিয়ের পর দুজনের ঘর সাজিয়ে দিয়েছিল প্রান্তিক সোমই, তাদের সন্তানলাভে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে গেলে ঢাক পিটিয়ে বেড়িয়েছে।