দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ রুক্ষ গলায় বলে উঠল কৌশিক, ভেবেছ কি তোমরা? বাড়িতে কাউকে ঘুমোতে দেবে না?
হঠাৎ দুটো উত্তেজিত সাপ যেন মন্ত্রপূত হল। চুপ করে গেল।
কিন্তু কতক্ষণের জন্যে? বড়োজোর কয়েক সেকেন্ড। ফণিনী আবার ফণা তুলল, তুই ছেলেমানুষ, এর মধ্যে কথা কইতে এসেছিস কেন?
কিন্তু টুবলু কি তখন আর ছেলেমানুষ ছিল? টুবলু হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক ধাক্কায় বড়ো হয়ে ওঠেনি কি? তাই টুবলু কৌশিকের গলায় বলল, নিজেরা ছেলেমানুষের বেহদ্দ করছ বলেই বলতে হচ্ছে।
তুই থাম্।
না, থামব না। তোমাকেই থামতে হবে। বলল কৌশিক জোর দিয়ে।
আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখের ভঙ্গিটা কেমন যেন বদলে গেল। মা বলল, আমায় থামতে হবে? তুইও তাই বলবি? ওঃ! অন্নঋণ? আচ্ছা, ঠিক আছে।
সে রাত্রে আর গোলমাল হল না। তারপর দিনই চলে গেল মা! আর যাবার সময় টুলুকে কিছু বলে গেল না।
টুবলুকে আর কেউ কিছু বলছে না। সে জানে না মা কোথায় আছে। টুবলুর মাথায় কুশ্রী একটা লজ্জার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কোথায় বসে বসে ষড়যন্ত্র আঁটছে খুব ঘৃণ্যতম একটা ঘটনা ঘটাবার।
দাদাবাবু! চাকরটা এসে দাঁড়াল। বলল, এখন কি খেতে দেওয়া হবে আপনাকে?
চাকর-বাকরদের সামনে মুখ তুলে কথা বলতে পারে না কৌশিক, তাই না হা ছাড়া বলাও হয় না কিছু। এখন হ্যাঁ বলে দিলে আর একবার ডাকের সম্মুখীন হতে হবে না, তবু কৌশিক বলে ফেলল, না।
চাকরটা চলে গেল। ওরাও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে রয়েছে বইকি! মা সত্যিই চিরকালের মতো চলে যাবে, এটা অবিশ্বাস্য, অথচ সেই অবিশ্বাস্য কথাটাই ক্রমশ সত্য হয়ে উঠছে। আর মায়ের উপর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তাদের। সঙ্গে সঙ্গে বাবুর উপর সহানুভূতিতে মন ভরে উঠছে।
আশ্চর্য! স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া আবার কোন্ সংসারে না হয়? বোঝা যাচ্ছে বটে ইদানীং বাবুর স্বভাব-চরিত্তির খারাপ হয়েছে, তা সেটাই বা কী এমন আশ্চর্য ঘটনা? তাই বলে চলে যাবে মানুষ ঘর-সংসার স্বামীপুত্তর ফেলে? এটাকে তারা ফ্যাশন ভাবছে, পয়সার গরম! অতএব তাদের মজলিশে এই নিয়ে আলোচনা এবং হাসাহাসির অন্ত নেই। পুরনো দিনের ভৃত্য নয়, তাই মনিব বাড়ির অশান্তিতে অশান্তি বোধ করে না, করে আমোদ বোধ।
তবে দাদাবাবুটাকে দেখলে কষ্ট হয়। আহা, বেচারার খাওয়া গেছে, খেলাধুলো গেছে, ঘুমও গেছে। তাই ওর সামনে বেশি কথা বলতে সাহস হয় না।
চাকরটা চলে গেল। আর একটু পরেই ঢুকল প্রদোষ। নন্দিতা গিয়ে পর্যন্ত এ ঘরে কোনোদিন ঢোকেনি সে, আজ ঢুকল। ঢুকেই বলে উঠল, তুমি নাকি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছ?
কৌশিকের মুখটা শক্ত হয়ে গেল, কৌশিক কাঠ হয়ে বসে রইল।
বাবা আবার বলল, ওরা বলছিল, যাচ্ছ না। স্কুল কামাই করবার মানে কি?
কৌশিক তবু তেমনিই বসে থাকে।
বাবা আবার বলে, ও রকম করার কোনো মানে নেই। কাল থেকে স্কুলে যাবে।
এবার কাঠের মুখ কথা বলে ওঠে, না!
না? স্কুলে যাবে না?
না।
চমৎকার! তাহলে তুমি হবেটা কি? রাস্তার ঝাড়ুদার? প্রদোষ ভাবছিল টুবলুকে শাসন করছে সে। প্রদোষ ভেবে দেখেনি টুবলু নামের সেই সর্বদা-আহ্বাদে-উছলে-পড়া ছেলেটা আর নেই। সে ছেলেটা মরে গেছে। তার চেয়ারে যে বসে আছে সে একটা বড়ো ছেলে। যার নাম কৌশিক।
তাই প্রদোষকে শুনতে হল, রাস্তার ঝাড়ুদাররা আমাদের থেকে অনেক ভালো।
ওঃ, তাই নাকি? তা বেশ, জ্ঞান যখন জন্মেই গেছে, তখন এটাই ভাবা উচিত, নিজের আখেরটা গুছিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
কৌশিক তিক্ত গলায় বলল, আচ্ছা, মনে রাখতে চেষ্টা করব।
প্রদোষ চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এল।
বলল, তা তুমিই বা কেন একবার চেষ্টা করলে না, মায়ের রাগ ভাঙাবার? অনেকটা তোমার ওপর রাগ করেও
কথা ভালো লাগছে না আমার। মাথা ধরেছে। বলে উঠে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়াল কৌশিক।
প্রদোষ একবার দাঁতে দাঁত পিষল, তারপর হঠাৎ শীস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল।
২. এত রাত্রে আবার
বিপাশা বলল, কী ব্যাপার এত রাত্রে আবার?
প্রদোষ মুখে একটু ব্যঞ্জনাময় হাসি ফুটিয়ে বলল, ঢুকতে দেবেন না বুঝি?
হ্যাঁ, আপনি বলেই কথা বলে ওরা।
কারণ পালিশটা হারাতে হাজী নয়, রাজী নয় মুখোশটা খুলতে। কেউটে সাপ খেলাবে, তবু ভাব দেখাবে যেন রবারের সাপ নিয়ে খেলছে।
ব্যঞ্জনার হাসি বিপাশাও হাসতে জানে বৈকি। সেই হাসির সঙ্গে তীক্ষ্ণ কথার হুল বসায় সে, না-দেওয়াই তো উচিত।
তাহলে ফিরে যেতে হয়।
বিপাশা মুখ টিপে হাসে, আমিও তাই বলছি।
এক পেয়ালা কফি না-খেয়ে নড়ছি না। হঠাৎ ভীষণ ইচ্ছে জেগে উঠল—
রাত্তির এগারোটায় আর কফি খায় না।
এগারোটা নয়, পৌনে এগারোটা।
ওই একই কথা।
দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইলেন মনে হচ্ছে। সত্যিই ঢুকতে দেবেন না নাকি?
ভাবছি—
অপমানিত হচ্ছি কিন্তু।
হচ্ছেন বুঝি?
হাসির ছুরি ঝলসায়। তাহলে তো দরজা ছাড়তেই হয়। শেষে পরে আবার বন্ধু এলে লাগিয়ে দেবেন!
বন্ধু এলে?
প্রদোষের চোখের কোণে এক ঝিলিক আগুন জ্বলে ওঠে, পালিত ফেরেনি এখনও?
কোথায়! বারোটার আগে কবে ফেরে? পকেটের সব টাকা ফুরিয়ে গেলে তবে তো ফিরবে।
ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বসে প্রদোষ।
সোফায় গা হেলিয়ে বলে, আচ্ছা, ও কেন তাস খেলে?
খেলতে জানে না বলে খেলে।
বাস্তবিক, আপনার বারণ করা উচিত। রোজ যখন হারে।
বিপাশা মুচকে হেসে বলে, হারাই ওর ভাগ্য। সব খেলাতেই হারছে।