- বইয়ের নামঃ শুধু তারা দুজন
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কারণ কিচ্ছু নেই
না না, মোটেই না। কারণ কিচ্ছু নেই।
কিচ্ছুটার উপর বিশেষ একটা জোর দিল প্রদোষ, তার সঙ্গে হাতের সিগ্রেটটায় টোকা দিল। ছাইটা অ্যাশট্রেয় যতটা না পড়ল, উড়ল তার বেশি। তারপর প্রদোষ উদার গলায় বলল, বলেছি তো সি ইজ এ গুড গার্ল—ও, তুমি তো আবার সাহিত্যিক মানুষ, বাংলাতে ভাব প্রকাশ করতে না পারলে চটে যাও–
আর একবার সিগ্রেটটায় টোকা দিল প্রদোষ, ছাই জমে ওঠেনি তবুও দিল।
প্রদোষ কি তার ভিতরের দ্বিধার ভস্মাবশেষটুকুকে ওইভাবে টোকা দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইছে? এটা তার প্রতীক?
প্রান্তিকের অন্তত তাই মনে হল। সাহিত্যিক প্রান্তিক সোম।
প্রদোষ হয়তো ওর ওই সাহিত্যিক বন্ধুর ভালোবাসাটুকু টোকা দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারছে না, তাই কৈফিয়ত দিচ্ছে, বাংলায় তাহলে কী বলব? তিনি একটি আদর্শ মহিলা তো? তাই বলছি। বাস্তবিকই সোম, ধরবার মতো কোনো দোষই নেই নন্দিতার। বরং হিসেব করে দেখলে, বলতেই হবে সর্বগুণসম্পন্না। বিষয় ধরে ধরে নম্বর দিলে প্রত্যেকটি বিষয়ে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট। স্ত্রী হিসেবে অতি উত্তম, গৃহিণী হিসেবে অতুলনীয়া, জননী হিসেবে তো কথাই নেই—মা যশোদা হার মানেন, সামাজিক ভূমিকায়—কী বলে তোমাদের বাংলায়? অন—অনবদ্য? কী? ঠিক হল? আর
প্রদোষ ওর স্বভাবগত বঙ্কিম হাসিটি হেসে বলে, আর যদিও আপাতত পরীক্ষার সুযোগ আসেনি তবু মনে হয়, অবশ্য অন্যের কাছে, প্রেয়সী হিসেবে এখনও যথেষ্ট চার্মিং। কাজেই দোষ টোষ কিছু দেখাতে পারছি না।
প্রান্তিক ওর এই বাচালতার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। বরাবরই প্রদোষ বেশি কথা বলে, কথার কায়দা দিয়েই যেন নিজেকে বিশিষ্ট করতে চায়, কথার ফুলঝুরি কেটেই নিজেকে বিকশিত করে। তবু আজ যেন বেশি বাচালতা করছে। এটা কি দুর্বলতা ঢাকবার ছল? নাকি শুধু খেয়াল? কিন্তু এ কী সর্বনাশা খেয়াল? প্রান্তিক তীক্ষ্ম চোখেই তাকিয়ে বলে, দোষ দেখাতে পারছ না, তবু ত্যাগ করতে চাইছ?
ত্যাগ? প্রদোষ শব্দ করে হেসে ওঠে। ত্যাগ করতে চাইছি এ-কথা কে বলল? বরং এ-কথা বলতে পার, তিনি আমার সম্পর্কে ভরসা ত্যাগ করুন এইটুকু প্রার্থনা করছি। সাদা বাংলায়, রেহাই চাইছি।
প্রান্তিক ওদের দুজনের বন্ধু। প্রদোষের, নন্দিতার। তাই প্রান্তিক ওদের জীবনের এই জটিলতার খবরে ক্ষুব্ধ, ব্যথিত। আর সেই বন্ধুর চিত্ত নিয়েই এসেছে, যদি পরামর্শ আর সহানুভূতির স্পর্শে ওদের দাম্পত্য-জীবনের ভুল-বোঝাবুঝির ফাটলটা মেরামত করে তুলতে পারে।
কিন্তু প্রদোষ বলেছে, ভুল-বোঝাবুঝি? নাথিং। পরিষ্কার সূর্যালোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। শুধু একটি মাত্র কথা—আমার আর ওকে ভালো লাগছে না।
আহত প্রান্তিক বলেছিল, শুধু তোমার আর ওকে ভালো লাগছে না? ওর কোনো দোষ নেই। তবুও?
প্রদোষ সেইভাবেই সোফায় হেলান দিয়ে সিগ্রেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে অলস বিলাসের ভঙ্গিতে বলে, তাই তো দেখছি। ভদ্রমহিলা তো সেদিকেও আমায় অসুবিধেয় ফেলেছেন। খানিকটা দোষ দেখাতে পারলে হয়তো তোমরা কিঞ্চিৎ শান্ত হতে।
প্রান্তিক স্থির গম্ভীর গলায় বলে, শুধু আমাদের কথাই ভাবছিস প্রদোষ? আর তোর বিবেক? তাকে শান্ত করবি কী দিয়ে?
বি-বেক! প্রদোষ আর একবার হেসে ওঠে। বলে, তুমি যে প্রায় বাবা মহারাজদের সুরে কথা বলছ হে! বিবেক দেখিয়ে আবার আমাকে সেই পুরনো ফ্রেমের খোঁটায় বেঁধে রাখতে চাও? তা বিবেকই যদি দেখাচ্ছ তো বলি, আমার বিবেক এইটাই বলছে, ভালো যখন লাগছে না আর তখন ওই এই ভালো লাগার ভাবনা কেন? সেটাই বরং অসততা।
প্রান্তিক গাঢ় গম্ভীর গলায় বলে, কিন্তু প্রদোষ, তুমি জানো তোমাদের দুজনের মধ্যেকার ভালোবাসা, তোমাদের সুখী সমৃদ্ধ দাম্পত্য-জীবন, আমাদের সকলের কাছে দৃষ্টান্তের মতো ছিল।
প্রদোষ আর একটা সিগ্রেট ধরাবার আগে ঠুকতে ঠুকতে বলে, তোমার নিজের কথার মধ্যেই কথার উত্তরটা রয়েছে সাহিত্যিক, ছিল। এখন আর নেই।
কিন্তু কেন নেই? না-থাকবার একটা যুক্তি থাকবে তো?
যুক্তি প্রদোষ আবার শব্দ করে হেসে ওঠে, সব কিছুতেই যুক্তি থাকবে এ তো তোমাদের ভারী আবদার হে! এই যে তোমার মাথাটা দেখতে পাচ্ছি, তুমিও অবশ্যই আর্শিতে দেখতে পাও, ওই মাথায় আগে কি বলে যেন—ভ্রমরকৃষ্ণ কেশদাম? তাই না? ছিল কিনা? তোমার চুলের সৌন্দর্য দেখবার মতো ছিল। কিন্তু এখন? এখন আর নেই! এখন মাথা-জোড়া টাকের আভাস। এর যুক্তি কি?
প্রান্তিক ক্রুদ্ধ গলায় বলে, এটা একটা তুলনা হল?
হল না কেন? তুমি বলছ একটা জিনিস যখন ছিল, এবং সুন্দর মূর্তিতে ছিল, সেটা চিরকাল থাকবে না কেন? না-থাকলে অন্তত তার যাওয়ার ব্যাপারে যুক্তি চাই। তাই উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছি সবকিছুর পিছনেই যুক্তি থাকে না।
প্রদোষের রং ময়লা, কিন্তু মুখের ছাঁদটি সুন্দর। মা-পিসি বলত—কুঁদেকাটা মুখ। বন্ধুরা বলত, গ্রিসিয়ান কাট। এখন ওর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে পাথর কাটা মুখই বটে। এ মুখের রেখায় রেখায় পাথরের নির্লিপ্ততা। প্রদোষ তার সেই নির্লিপ্ত মুখ নিয়ে বলছে, তার বিবাহিতা স্ত্রীকে তার আর ভালো লাগছে না।—না, কারণ কিছু নেই। শুধু ভালো লাগছে না। তা সেটাকেই যদি কারণ বল, তো কারণ।