মেয়েটি বহু কারুকার্য করা একখানি কাঁথা বিছিয়ে টানটান করে ঘুমন্ত শিশুটির গায়ে ঢেকে দেয়। ঢাকা দিয়ে অপরিসীম তৃপ্ততা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে।
সুমনার কোলের কাছে শুয়ে থাকা জীবটাও এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আলোর তৃষ্ণায় আকুলতা করবার ক্ষমতা আর এখন নেই।
কিন্তু সুমনাও কি ঘুমিয়ে পড়বে?
ওইরকম সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত হয়ে, নিশ্চিন্ত শান্তিতে! ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে তার শরীর। না কি প্রশ্নোত্তরের কাঁটাবনের হাত থেকে রক্ষা পেতেই তার শোয়ার আকুলতা?
কে জানে কী জন্যে, গুটিগুটি হয়ে শুয়েই পড়ে সুমনা। শিশুটাকে হাতের আড়ালে আগলে। বালিশ নেই, কাঁথা নেই, যদি পড়ে যায়।
অতঃপর শাশুড়ি বউয়ের মধ্যে নিম্নস্বরে কথা হতে থাকে।
কী ফ্যাশানই হয়েছে আজকাল! এয়োস্ত্রী মানুষ, কোলে কচি ছেলে, মাথায় একটু সিঁদুর নেই, হাতে নোয়া নেই, ছিঃ!
বউ বলে, কতজনই তো পরে না। ওই হয়েছে এখন।
ছিঃ, দেখে ঘেন্না করে।
শ্রীরামপুরে নেমে গেল ওরা।
আর হঠাৎ সেই সময় বই থেকে মুখ তুললেন কান্তিকুমার। বললেন, সুজাতা, তুমি অনায়াসে জানলার কাছ থেকে সরে এসে এদিকে বসতে পারতে!
.
আগে থেকে খবর দিয়ে এসেছিলেন কান্তিকুমার। স্টেশনে গাড়ি ছিল।
ড্রাইভার সেলাম করে দাঁড়িয়েই, হতচকিত হয়ে তাকাল সুমনার দিকে।
সুমনার মুখ অন্যদিকে ফেরানো।
সুমনার বুকের কাছে আঁকড়ানো শাড়ি দিয়ে মোড়া একটা রহস্যময় বস্তু।
ড্রাইভার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেবার অবসরে কান্তিকুমার আর একবার বলেন, সুজাতা, ওটাকে তোমার কাছে রাখা কি একেবারেই অসম্ভব?
সুমনা চমকে তাকায়।
আর সুজাতা চাপা আক্রোশের গলায় বলে ওঠে, অসম্ভব তো নিশ্চয়! কাছে নিয়ে যদি আমি গলা টিপে দিই।
অদ্ভুত!
সুমনাকে উপলক্ষ করেও এমন বিষাক্ত কথা বলতে পারছে সুজাতা! কান্তিকুমার চুপ করে যান।
ড্রাইভারটা কী ভেবে কোনও প্রশ্ন করল না।
.
এরা এসে পড়ায় হইহই পড়া উচিত ছিল। কিন্তু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল সবাই! দিদি দিদিকরে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল না কেউ। সভয়ে সরে সরে বেড়াতে লাগল সুমনার নিজের ভাইবোনেরা, খুড়তুতো ভাইবোনেরা।
আর সুমনা?
সেও তো কেমন নিথর হয়ে গেছে। আগের সুমনা তো আর নেই। তার কথার সমুদ্র শুকিয়ে গেছে। যেন।
ধীরে ধীরে গিয়ে নিজের খাটের একপাশে শুইয়ে দেয় শাড়ি-জড়ানো বস্তুটাকে। বসে থাকে ঘরের মধ্যে।
অনেকক্ষণ পরে ছোটখুড়ির মেয়ে অরুণা এসে ডাকে,দিদি, মা বললে, হাতমুখ ধোও। চা হয়ে গেছে।
হাতমুখ ধুতে গিয়ে জলের কলটা খুলে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে অনেকক্ষণ কিছু না ভেবে দাঁড়িয়ে রইল সুমনা।
তারপর ভাবল, আমি এমন বোকার মতো চুপ করে আছি কেন। এমন অপরাধী-অপরাধী ভাবের কী দরকার? তারপর ভাবল, ওদের অনুচ্চারিত প্রশ্নভরা চোখই আমার বল হরণ করছে। ওরা চিৎকার করে প্রশ্ন করুক না! বলুক না–সুমনা, এ কী?
তখন সুমনা তর্ক করবে, প্রশ্ন করবে, মানুষের সংজ্ঞা কী, তা জানতে চাইবে।
কিন্তু ওরা কথা বলছে না।
বললও না!
শুধু সুমনা যখন চা খেয়ে উঠে যাচ্ছে, তখন জেঠি জপের মালা হাতে করে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, তোর মা তো চিঠিতে লিখেছিল শরীর বেশ সারছে, তা কই? দেখছি না তো কিছু?
অনেকক্ষণ–না না, অনেকদিন যেন কথা কয়নি সুমনা; তাই সুমনার গলার স্বর বুজে আছে। তাই খোলা গলায় কথার উত্তর দিতে পারে না সে।
শুধু অস্ফুটে বলে, ভালই তো আছি।
কী জানি বাছা, ভাল থাকার তো কিছু দেখছি না। জেঠি মন্তব্য করেন, গাল দুটো তো চড়িয়ে ভাঙা, চোখের কোলে কালি।
যতটা নয় তার বেশি করে বলেন জেঠি।
.
ভাল আছি, ভালই আছি–এ কথা কে শুনতে চায়? চায় না। তাই ভাল থাকা–দেখলে ভাল লাগে না। আর অন্যের আপন নিভৃতির ভাললাগাটুকুকে টেনে হিঁচড়ে উপড়ে ফেলতে পারলেই বুঝি বাঁচে মানুষ!
তাই সুমনার একটা কুড়িয়ে পাওয়া পুতুল নিয়ে খেলার ভাললাগাটুকু কেটে ছিঁড়ে তছনছ করে দিতে চায় সবাই।
.
অজস্র কৌতূহলের মন সজাগ হয়ে উঠেছে কান্তিকুমারদের বাড়ির নতুন খবরে। আশে-পাশে ধারে কাছে যেসব মন ও-বাড়ি সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে বসে থাকত, সেইসব মন।
কিন্তু যারা ধারে কাছের নয়? যারা কান্তিকুমারদের নিজের বাড়ির?
সেখানেও সেই স্তব্ধতাই রয়ে গেল নাকি?
চুপ হয়েই থাকল সবাই?
কেউ কোনও প্রশ্ন নয়?
কেউ কোনও প্রতিবাদ নয়!
যেমন প্রথম মুহূর্তে করেছিল। প্রশ্নহীন অবাক দৃষ্টি নিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকা।
না, তাই কি হয়?
অপ্রতিবাদে কেউ এতটুকু এদিক ওদিক মেনে নেয় না, আর এ তো একটা বিরাট অনাচার। সুমনার কাছে পুতুলের মতো বলেই তো আর সেই ভয়ংকর জিনিসটা পুতুল হয়ে গেল না?
অতএব গুমোট ভেঙে ঝড় ওঠে।
প্রশ্নে আর প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে সংসার। কেন…কেন..কী বলে…কোন্ সাহসে…?
.
ব্যাপারটা নিতান্ত গুরুতর, তাই প্রথম নান্দীপাঠ করেন কান্তিকুমারের দাদা শান্তিকুমার। খুব গম্ভীর আর ভারী গলায় বলেন, মেয়েরা অনেক বিষয়েই শৈশব অতিক্রম করে না। জানা কথা! কিন্তু তুমি? তোমার বিবেচনা বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল কী করে বলে দিকি কান্তি?
বৈষ্ণবচরণাশ্রিত ভক্তিমান্ মানুষ, কখনও চেঁচিয়ে কথা বলেন না, তুমি ছাড়া কাউকে তুই বলেন না।
কান্তি ক্লান্তকণ্ঠে বলেন, কী করব, এমন জেদ ধরল।