সেই বকুনিটা অবশ্য তার খুকুর প্রতি। মাতৃজনোচিত সমস্ত বকুনিগুলিই সেই শৈশবেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিল সুমনা।
এমনকী তার খুকু চোখে কয়লার গুঁড়ো লেগে কেঁদে ওঠায় বকতে কসুর করেনি–একটু কয়লার গুঁড়ো লেগেছে তো কী হয়েছে? কাঁদবার কিছু নেই এতে। রেলে চড়বার শখ কেন তা হলে? রেলে তো কয়লার গুঁড়ো থাকবেই।
তার একটু পরেই কিন্তু সুজাতাকে উঠতে হয়েছিল সুমনার চোখে জলের ঝাঁপটা দিতে, আর তাকে কোলে নিয়ে ভোলাতে।
আজ আর সুমনা পাখির মতো কলকাকলি তুলছে না। আজ সুজাতাকে উঠতে হবে না সুমনাকে ভোলাতে।
জিজ্ঞেস করাও চলবে না, হ্যাঁ রে চোখে জল পড়ছে কেন? কয়লার গুঁড়ো পড়েছে?
অথচ লাল লাল চোখটা বারবার জানলার দিকে ফেরাচ্ছে সুমনা।
গত দুদিন থেকে মার সঙ্গে কথা বন্ধ।
সুজাতার অপরাধ, ও শেষ মুহূর্তে শেষ চেষ্টা হিসেবে ওখানকার বাসন-মাজা দাইটার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে সাঁওতালদেরই একটা বাঁজা মেয়েকে আনিয়েছিল। মনে করেছিল বন্ধ্যার দুঃখ বর্ণনা করে, আর বন্ধ্যার হৃদয়ের আকুলতা আকুতির কথা তুলে, মন গলিয়ে ফেলবে সুমনার। কিন্তু ঝিয়ের সামনে অপদস্থ করেছে সুমনা সুজাতাকে। দেয়নি।
ঘরে এসে বলেছে, মা, আর যাই করো করো, ছোটোমি কোরো না।
সুজাতা ছোটোমি করেছে!
এই কথা বলেছে তার পেটের মেয়ে!
সুমনা!
যে মেয়েকে সে রক্ষণশীল বাড়ির মধ্যে থেকেও সংগ্রাম করে করে সমস্ত আধুনিকতা আর উদারতার সুযোগ দিয়ে মানুষ করেছে!
তবে আর কথা বলবে কেন সুজাতা।
.
ঝনাৎ করে থেমে গেল গাড়ি।
এসে পড়েছে বর্ধমান। কী আশ্চর্য, কখন চলে গেছে সময়, কখন বাংলার মাটিতে এসে ঢুকেছে অজগর গাড়িটা?
দিনের গাড়ি!
অতএব নিভৃত শান্তির আশা বাতুলতা। তবু যে এতক্ষণ ছিল সে শান্তি, এই আশ্চর্য!
হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লেন এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা, আর তাঁর সঙ্গে একটি তরুণী বউ। বউটির কোলে কাঁথায় মোড়া একটি পুঁটুলি।
কাঁথায় মোড়া পুঁটুলি নিয়ে কমবয়েসী মেয়ে বউদের তো কতই গাড়িতে উঠতে দেখেছে, তবু কেন যেন দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে সুজাতার।
ওই একবার মাত্র দৃকপাত করেই ও আবার জানলার বাইরে মুখ ফেরাল।
কিন্তু সেটাই তো ভুল। কেন তাকিয়ে রইল না তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে?
বারেবারে এই ভুলের বোকামিই করে বসছে সুজাতা।
বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, যখন একসময় অন্যমনস্কতার অতলে তলিয়ে গেছে ও, তখন হঠাৎ কানে আসে সেই কর্ণবিদারী প্রশ্ন।
যে প্রশ্নের ভয়ে তখন বুক কেঁপে উঠেছিল তার।
এইটি বুঝি প্রথম?
নিজের ভুল বুঝতে পারে সুজাতা। বুঝতে পারে নিজেই ঘাঁটি আগলে বসা উচিত ছিল তার। এমন কথাও তো বলতে পারত, শিশুটা সুজাতারই। প্রথম নয়, শেষ। হতে পারে না সুজাতার?
চল্লিশ বছর বয়সে কি এমন ঘটনা ঘটে না কোনও মেয়ের?
হ্যাঁ, তাই বলতে পারত! বলত–শেষ কুড়োনো বলেই অগ্রাহ্য করে আর তাকিয়ে দেখি না। তাই বড় মেয়েই দেখেশোনে ওকে। এ সবই বলতে পারত সুজাতা।
কিন্তু এখন আর হয় না।
এখন সেই প্রশ্নটি উচ্চারিত হয়ে গেছে! সুজাতার কানে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে সে শব্দ।
এইটি বুঝি প্রথম?
সুজাতা তাকিয়ে দেখে তীক্ষ্ণ কঠোর দৃষ্টিতে।
ওদের দিকে নয়, মেয়ের দিকে।
সুমনা দেখতে পায় না সে দৃষ্টি।
তাই সুমনা মৃদু হেসে বলে, কী যে বলেন! এটা হচ্ছে কুড়িয়ে পাওয়া!
প্রশ্নকর্তী অবশ্য এ উত্তরকে রহস্য ভেবেই হেসে ওঠে। বলে, কোথায়? বনে জঙ্গলে?
হাঁসুমনা বলে, বেড়াতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি জঙ্গলের ধারে পড়ে পড়ে কাঁদছে।
সুজাতা তীব্র দৃষ্টিতে কান্তিকুমারের দিকে তাকায়।
বইয়ের মধ্যে কি সত্যি সমাধিস্থ হয়ে গেছে লোকটা। একটা কিছু করুক। একটা কিছু বলে উঠুক! এ প্রসঙ্গটা যাতে বন্ধ হয়, তার ব্যবস্থা করুক! কিন্তু লোকটা কিছুই করে না।
সত্যি শুনতে পাচ্ছে না, না, শুনতে না পাওয়ার ভান করছে?
বউটি কিন্তু সেটাও পরিহাস ভেবে ইত্যবসরে নিজের কথা শুরু করে দিয়েছে!
তাই তো দেয় লোকে।
নিজের কথা কইতেই তো ভালবাসে। নিজের কথা কইবে বলেই বৃথা দু-একটা প্রশ্ন করে পরকে।
ওটা হচ্ছে কথা তোলার ঘর!
ওই ঘরের পিঠে ঘর তুলে তুলে বুনে তুলবে নিজের মহিমা, নিজের পরিচয়।
সে যা কষ্ট পেয়েছি ভাই! ওই যে সঙ্গে আমার শাশুড়ি রয়েছেন। খুব ভাল। কী যত্নই করেছেন আমায়! আমি বলি, বাবাঃ, এত কষ্ট! এই কাণ্ডকারখানা করে এক-একটা মানুষ পৃথিবীতে আসে? তবু পৃথিবীতে এত কোটি কোটি লোক!… ভাবলে আশ্চয্যি লাগে না ভাই? যাই বলুন ভগবান খুব একচোখা, তাই না? যত যন্ত্রণা মেয়েদের ভাগে। ভগবান নিজে পুরুষ বলে,..বলুন? সত্যি বলছি। কিনা?
সুজাতার মুখে আসে,ওগো বাছা, একটু সভ্যতা-ভব্যতা বজায় রেখে কথা বলো, গাড়িতে একটা পুরুষ বসে রয়েছে
কিন্তু পারে না।
বলতে গিয়ে থেমে যায়।
কে বলতে পারে সেই কথাটুকু থেকেই বচসা হয়ে যাবে কিনা। যে মেয়ে বিগলিত আনন্দে হেসে হেসে কথা বলছে, সে এক্ষুনি সাপিনীর মতো ফোঁস করে উঠবে কি না।
অতএব কিছু না বলাই ভাল। মেয়েটা কথার গাড়ি চালিয়েই যায়।
.
ওমা, ও কী, শাড়ি পেতে শুইয়েছেন কেন? কাঁথা করতে পারেন না? অবিশ্যি প্রথমবার আর নিজে কে করে, তা নয়। পাঁচজনেই করে দেয়। তবে বেশি সভ্যরা আবার কাঁথা করে না, তোয়ালেয় শোয়ায়। যাই বলুন, কিন্তু শাড়িতে!..ইস আমি কি বোকা! সব বোধহয় বাক্সে তুলে ফেলেছেন। শুধু ট্রেনের মধ্যে যা হোক করে! কিন্তু ভাই ছোটদের তোয়ালের থেকে কাঁথাই মানায়, তাই না? বেশ আদর আদর ভাব থাকে।