অপটু হাতে দুধ খাইয়ে অসাব্যস্ত হাতে নাইয়ে পটু আর সাব্যস্ত হয়ে উঠল সুমনা। বুকে তার সত্যকার সুধাঁধারা সঞ্চিত হয়ে না উঠুক, স্নেহের সুধা জমে উঠল বুকভরে।
আর সকলের উপর আরও একটা জিনিস তীব্র হয়ে উঠল, সেটা হচ্ছে জেদ।
জেদ আর মমতা।
কঠিন আর কোমল।
এই দুটো হৃদয়বৃত্তি সুমনাকে অন্ধ করে রেখেছে। কাজেই কান্তিকুমার যে ভাবছিলেন হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা কিছু পরিবর্তন হবে, তা আর হয় না। যথানিয়মে বাক্স-বিছানা গোছানো হয়। এখানকার লেনদেন চোকানো হয়, ট্রেনের টিকিট কাটা হয়।
হয় না শুধু একটা কাজ।
সুজাতার বাজার করা হয় না।
এখানকার লোহার বাসন সস্তা, এখানকার বঁটি কাটারি ভাল, তাই সুজাতা মনে মনে সংকল্প করে রেখেছিল যাবার আগে একপ্রস্থ ঘর-সংসারী বাসন কিনে নেবে। না, তাদের সেই বৃহৎ গুষ্ঠির উপযুক্ত বিরাট বাসন-কোসন নয়। ছোট্ট সংসারের মতো। সেই সরঞ্জামগুলি নিয়ে বছরে বছরে বেড়াতে বেরোবে সুজাতা। সব ছেলেমেয়ে কটিকে সঙ্গে নেবে, এখানে সেখানে ডেরা বাঁধবে আর মনের মতো করে, মনের সাধ মিটিয়ে যত্ন করবে তাদের।
কিন্তু আর কী দরকার দোকানে বাজারে? ভবিষ্যতের সেই উজ্জ্বল ছবি তো কালি ধেবড়ে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে।
তবু কান্তিকুমার একবার বললেন, তুমি যে সেই একদিন কীসব কিনবে টিনবে বলেছিলে?
সুজাতা রুদ্ধ কণ্ঠ আর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বলেছিল, ঠাট্টা করছ?
ঠাট্টা!
তা ছাড়া আর কী? ভেবেছিলাম আবার যদি কখনও–তা আর আমি কখনও কোথাও বেরোব?
আহা তা একেবারে অত হতাশ্বাস হবার কী আছে? সংসারে কত ভাঙাগড়া হয়, কত বদল হয়–
এরপর যা বদল হবে, দুঃখের দিকে যন্ত্রণার দিকে, বেশ বুঝতে পারছি।
অতটা ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক নয়। যাবে তো চলো।
নাঃ। আমার আর মন নেই। সুমির দুর্মতি আমার মন ভেঙে দিয়েছে।
তবে থাক। কী করছে সে?
কী আবার? সেই কুড়নো মানিক বুকে করে বসে আছে! আশ্চয্যি আমার কপাল! জগতে এত মেয়ে আছে, কারও জীবনে কোনও সমস্যা নেই।
কান্তিকুমার তর্ক করলেন না।
বললেন না, এ তোমার ভুল ধারণা সুজাতা, সমস্যা অনন্ত। সবাইয়ের ভাগ্যেই কিছু না-কিছু এসে জোটে।
বললেন না, কারণ তাঁর নিজের মনও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তিনিও এই বিদঘুটে সমস্যাটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। লোকনিন্দের ভয়ে নয়, সে ভয়কে কান্তিকুমার মনের জোর দিয়ে কাটিয়ে উঠছিলেন; কিন্তু সুমনা যে বদলে গেল। সুমনা যে হারিয়ে গেল।
কান্তিকুমারের একান্ত আদরের একান্ত আশার সুমনার মৃত্যু ঘটেছে। সেই শোকস্তব্ধ করে দিয়েছে কান্তিকুমারকে।
আর কি কোনওদিন বেঁচে উঠবে সুমনা?
আগেকার সেই হাসিতে উজ্জ্বল, খুশিতে উচ্ছল মুখর মূর্তি নিয়ে?
.
শোকাচ্ছন্ন তিনটি মূর্তি নিঃশব্দে তাদের এই কয়েক সপ্তাহের বাসস্থান ছেড়ে ট্রেনে গিয়ে ওঠে।
কান্তিকুমার শুধু বলেন,মেঘ করেছে, বৃষ্টি আসতে পারে।
আর কিছু না।
যেন এই খবরটা খুব জরুরি। সুজাতা বলে, স্টেশনে বাড়ি থেকে গাড়ি আসবে কিনা কে জানে। জানে নিশ্চিত আসবে, তবু বলে।
সুমনা কিছু বলে না।
.
ট্রেন চলতে থাকে।
সুজাতা জানলায় মুখ রেখে বসে থাকে নির্বাক। কান্তিকুমার একখানা বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছেন ট্রেন চলার সঙ্গে সঙ্গে।
সুমনা বসে আছে নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে। অনেক দুঃখ, অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটা প্রসন্ন কৌতূহলের দীপ্তি মুখে মেখে।
জানলা দিয়ে এসে পড়া আলোর দিকে নীল কাঁচের মতো চোখ দুটিতে কী অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটা! অন্য আর সব শিশুর মতোই তো ওরও সমস্ত চেতনায় আলোর পিপাসা।
দু হাতের মুঠি পাকিয়ে অত লড়ালড়িই বা কেন ওর? যতক্ষণ জেগে আছে ততক্ষণ আর ওই লড়াইয়ের আস্ফালনের শেষ নেই!.. মনে মনে হাসে সুমনা।
ভাবে, এটা কি শিশুমাত্রেরই স্বভাব?
পৃথিবীতে এসে যে সব-কিছুর জন্যেই লড়ালড়ি করতে হবে, তা শিখে এসেছে বলেই তার মহলা দিচ্ছে?
না কি শুধু এই ছেলেটাই?
ও বুঝে ফেলেছে ওকে লড়াইয়ের জোরে জায়গা করে নিতে হবে।
এর আগে কি সুমনা এত ছোট শিশু দেখেনি আর কোথাও? তাই জানে না তারা কোন বয়েসে কী কী করে!
কোন বয়েস!
কী জানি এর কত বয়েস।
ডাক্তার পরে বোধ করি সন্দেহটা ঝেড়ে ফেলেছিল। হয়তো ভেবেছিল সন্দেহটা পোষণ করতে হলে তো তার নিজের বিদ্যাটাই মিথ্যে হয়ে দাঁড়ায়। এতদিন ধরে দেখছে সে সুমনাকে। তাই আবার স্বেচ্ছায় এসেছিল। বলেছিল, সদ্যোজাত নয়, কয়েকদিনের। সেই কয়েকদিনটা কদিন? এই কুসুমসুকুমার অসহায় শিশুটার ওপর মায়া পড়বার উপযুক্ত সময় নয় সেটা? সুমনা কদিন দেখছে? মাত্র নদিন। এই ন দিনেই তো সে ভাবতে পারছে না এটাকে অনিশ্চিত অন্ধকারে ফেলে দেওয়া যায়। কী পেলব-কোমল মুঠি দুটি! কী অদ্ভুত রকমের নরম ভঙ্গিমাময় ঠোঁট! কী উজ্জ্বল নীল চোখ।
ওই চোখ দিয়ে ও হয়তো সুমনার দিকে তাকিয়ে দেখছে। দেখছে সেখানে আশ্রয় আছে, না, স্বার্থপরতা আছে।
লোকে বলে শিশু নাকি অন্তর্যামী!
.
আর সুজাতা ভাবছিল অনেকদিন আগের কথা; তখনও অঞ্জনা জন্মায়নি, জন্মায়নি অভীক, অজীন। সুজাতা তার দিদির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল হাজারিবাগে।
ট্রেনে চেপে সুজাতা জানলা থেকে নড়েনি, পাছে এককণাও সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। কান্তিকুমার অমনি বইয়ের মধ্যে ডুবে বসে ছিলেন, আর সুমনা একটা বড় ডলকে কোলে বসিয়ে সারাক্ষণ একা একা বকবক করতে করতে চলেছিল।