তাই মাকে বেশ দুকথা শুনিয়ে দিয়ে রাগ করে দুধটা আর পলতেটা নিয়ে সরে গিয়েছিল সে। যা পারে মায়ের আড়ালেই করবে।
সুজাতা মিনিট গুনছিল কখন কান্তিকুমার আসেন।
কিন্তু কান্তিকুমার এসেই বা কী করতে পারলেন? বলতে পারলেন কি দূর করে ফেলে দে ওটাকে? তখনই যদি বলতেন, হয়তো কাজ হত।
এখন ওর মায়া পড়ে গেছে।
এখন শেকড় বসে গেছে।
এখন সুমনা বলছে, তোমরা বরং আমাকে ত্যাগ করো, আমি ওকে ফেলতে পারব না।
হ্যাঁ, সেদিন কান্তিকুমার ছিলেন না।
কান্তিকুমার ফিরে এসে শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর বলেছিলেন, কাজটা ভাল করোনি সুমনা!
বলেছিলেন, তবু কি সেই অখাদ্যটার জন্যে ডাক্তারবাড়ি যেতে কসুর করেছিলেন?
কসুর করেননি, হয়তো হঠাৎ বাড়িতে একটা জীবহত্যে ঘটে গেলে বিপদ আসবে বলেই হয়তো বা সুমনার নির্বেদে।
কান্তিকুমারের দিক থেকে ভাবতে গেলে প্রথমটাই।
মেয়ের কীর্তিতে বিচলিত কান্তিকুমার ভেবেছিলেন ডাক্তারের কাছে যাওয়াই ভাল। এই বেলা সবিশেষ বলে লোকটাকে সাক্ষী রাখতে। বাচ্চাটা মরে গেলে, মানে মরে তো যাবেই, তখন অনেক। ফ্যাসাদে পড়তে হবে।
গিয়েছিলেন। পরিচিত ডাক্তার।
এখানে এসেই তো সর্বপ্রথম কাজ হয়েছিল ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
ডাক্তার শুনে বললেন, বলেন কী? কোথায়?
জানি না কোন দিকে বেড়াতে গিয়েছিল। ভাল করে জিজ্ঞেস করা হয়নি। বলল তো জঙ্গলের ধারে।
একা বেড়াতে গিয়েছিল নাকি? ওষুধপত্র গোছাতে গোছাতে ডাক্তার বলেন, আপনারা সঙ্গে যাননি?
না। আমি একটু স্টেশনের দিকে গিয়েছিলাম। ও বলল, ডাক্তারবাবু আমায় হাঁটতে বলেছেন।
ডাক্তার একটু হাসেন।
হ্যাঁ, তা বলেছিলাম বটে। নিন, এখন কী মুশকিল বাধালো দেখি। অনেকদিন আগে আর একবার এধরনের একটা কেস হয়েছিল এখানে। নইলে এই ঘুমন্ত গ্রামে চাঞ্চল্যকর কিছু তো কখনও ঘটে না মশাই। বড়জোর একটা নেকড়ে বেরোল তো ঢের। ছুটিছাটায় চেঞ্জাররা আসে, স্থায়ী কোনও রোগী থাকলে বাড়িভাড়া করে থাকে কেউ কেউ। এখানকার সস্তা হাঁস মুরগি কিছু ধ্বংস করে চলে যায়। ঘুমন্ত দেশ আবার ঘুমোয়।
পথে চলতে চলতে কান্তিকুমার বলেন, সেই যে এরকম একটা কেসের কথা বলছিলেন, কী হল তার?
ডাক্তার বলেন, হল আর কী। একটা কেলেঙ্কারিই হল। সে এমনই এক চেঞ্জার ভদ্রলোক বললেন তাঁর বোন একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছেন, এখন কী হয়, কেষ্টর জীব! আমরা আর কী করব মশাই, বললাম, দেওঘরে একটা অনাথ আশ্রম আছে, দিয়ে দেবার চেষ্টা করুন। ভদ্রলোক হাত পা ছেড়ে দিয়ে বললেন, খোঁজ করেছিলাম, তারা বলেছে অত ছোট্ট বাচ্চা নেয় না। তারপর মশাই বোনের নির্বুদ্ধিতার কথা বলে অনেক হাত পা ছুঁড়লেন, অনেক গালিগালাজ করলেন, বললেন, রাস্তা থেকে ছেলে কুড়িয়ে আনল কী বলে! একেই বলে স্ত্রী বুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। শেষে মশাই লজ্জার কথা কী বলব, প্রকাশ হয়ে গেল, বোনেরই ব্যাপার! বিধবা বোন।
চলতে চলতে থেমে পড়লেন কান্তিকুমার। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, এ কাহিনীটা আমাকে শোনানোর আপনার কোনও উদ্দেশ্য আছে ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার থতমত খেলেন।
বললেন, না না, সে কী কথা! কী আশ্চর্য! আপনি তো মশাই সাংঘাতিক লোক!
.
এ তো দেখছি রীতিমত হেলদি চাইল্ড! ডাক্তার মন্তব্য করেন, কে বললে মশাই, এক্ষুনি মারা যাবে? মারা যাবার কোনও লক্ষণই দেখছি না–হাসলেন ডাক্তার, বুঝতেই পারছেন ঝড় খেয়ে বেঁচে ওঠা চারা। সতেজ বেশি। পৃথিবীর আলো দেখবার আগে থেকেই ওকে পৃথিবী থেকে সরাবার কী ষড়যন্ত্র না চলেছিল! শেষ অবধি ফেলিওর হয়েই
সমাজের অধঃপতন সম্পর্কে বেশ খানিকটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন ডাক্তারবাবু। বাচ্চাটা সম্পর্কে নির্দেশ দিলেন কিছু কিছু ওষুধ দিলেন এবং জানিয়ে গেলেন, অনাথ আশ্রমে দিতে গেলে অনেক ঝামেলা, পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়, তার থেকে সবচেয়ে ভাল যদি স্বেচ্ছায় কেউ পালন করতে চায়। বললেন, সাঁওতাল মাগীফাগিগুলো কেউ কেউ আছে–ছেলে ক্যাঙলা। সন্ধানে থাকব, নিতেও পারে। সেই ভদ্রলোকের বোনেরটিকে তো ওই একটা সাঁওতালনি এসেই মহোৎসাহে তুলে নিয়ে গেল।
ডাক্তারকে হ্যারিকেন ধরে পৌঁছে দিয়ে আসে এদের চাকর।
সেই সন্ধ্যার কথাটা আবার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করতে থাকে সুজাতা।
মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি, কিন্তু নিজে সে লক্ষ করেছিল, ডাক্তার বারবার কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল সুমনার দিকে। কেমন একটা গূঢ় মর্মভেদী লক্ষ্যে। অথচ ওই ডাক্তারই দেখেছে এতদিন সুমনাকে। তবু, মানুষের স্বধর্ম! সন্দেহ বস্তুটাই তার মজ্জাগত।
ডাক্তারের সেই দৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে সুজাতা, তার জায়েদের চোখে, দেওর-ভাশুরের চোখে, শাশুড়ি-ননদের চোখে, নিজের ভাই ভাজ বোন ভগ্নীপতির চোখে, আত্মীয় অনাত্মী; পাড়া-প্রতিবেশী ঘর পর সকলের চোখে।
গূঢ় মর্মভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
সেই দৃষ্টির শরশয্যার মধ্যে গিয়ে পড়তে হবে তাকে।
আর অকারণ।
শখের খেয়ালে মায়ের জন্যে এই শরশয্যা পাততে চাইছে সুমনা।
চাইছে কেন, পাতলই তো।
.
সুজাতার চালে ভুল ছিল।
সুজাতা যদি ওই অসহায় জীবটাকে কেবলমাত্র বিপদ বলে গণ্য না করত, যদি ওটাকে বিদেয় করে দিয়ে বিপদ-মুক্ত হবার জন্যে অত হইহই না করত, যদি কেষ্টর জীব বলে একটু করুণা করত, তা হলে হয়তো সুমনা বাঘিনীর শাবক আগলাবার মতো অমন করে আগলাত না সেটাকে। আর হয়তো বা অত মায়াও পড়ত না ওর।