আর সুমনাই ভরসাই।
সুমনার ভরসাতেই ওইসব কুচোকাঁচাও যাত্রার পারমিট পায়। আর এ যাবৎ সুমনার ভিতরকার ওই মাতৃস্নেহটুকু সুমনার সদ্গুণ বলেই কীর্তিত হয়েছে।
কিন্তু সবেরই তো একটা সীমা আছে।
সেদিন তাই স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুজাতা। সুমনার সীমাহীন সাহসিকতায়।
যখন সুমনা বুকের কাছে ওটাকে জাপটে ধরে সামনে এসে দাঁড়াল, সুজাতা তখন নিজে হাতে রাত্রের রান্না করছিল। মেয়ে যেটি ভালবাসে। স্বামী যেটি ভালবাসে। মনটা খুশিতে ভরা।
এতদিনে মেয়ের খিদে হয়েছে, রুচি হয়েছে, সুজাতা যেদিন যেটি রাঁধছে, মহোৎসাহে খাচ্ছে। এমনকী চির উদাসীন স্বামী পর্যন্ত মাঝে মাঝে বলে ফেলেন, তা এইসব ভাল ভাল রান্নাগুলো কলকাতার বাড়ির ঠাকুরকে শিখিয়ে দিতে পারো না? এতসব জানো৷
সুজাতা মুখে বলে, হ্যাঁ, শেখালেই শিখছে যে! যে আসে সেই তো নিজেকে মস্ত একটি পাকা রাঁধুনি বলে জাহির করে। যে খুন্তি ধরতে জানে না, সেই বলে, সায়েব বাড়ি কাজ করে এসেছি।
কিন্তু মনে মনে বলে, সেই বারো ভূতের বাড়িতে এইসব শৌখিন রান্না! আর জানো না তো ফৈজৎ কত। তোমার মায়ের এক আতপ চালের হেঁসেল, তোমার বোষ্টম দাদা বউদির এক পিয়াজ মাংস বর্জিত আমিষ হেঁসেল, আবার অমেধ্য ভোজনকারীদের আর এক হেঁসেল। আর তারাই তো জাতিচ্যুত। যারা মাংস খায় তারা তো পতিত। তাদের জন্যে বরাদ্দর ব্যবস্থাও নগণ্য।
মনের কথা মুখ ফুটে বললে কান্তিকুমার বিরক্ত হবেন, সেকথা হাড়ে হাড়ে জানা সুজাতার। কখনও কখনও অন্য বিষয়ে বলে ফেলে, কিন্তু খাওয়াদাওয়ার ব্যপারে নৈব নৈব চ। কে জানে বা স্বামী কী মেজাজে ঝপ করে বলে বসবেন, এসব খেয়ে আর সহ্য হচ্ছে না আমার।
সুজাতার নিজের হাতে গড়া এই দেড় মাসের সংসারটিই এখন সুজাতার জীবনের অক্ষয় সঞ্চয়।
সুমনা অবশ্য মাঝে মাঝে বলে, বাবাঃ সারাদিন কী এত কাজ! এত খাটতেই পারো তুমি মা।
কিন্তু সুজাতা সেকথা হেসে ওড়ায়। এইটুকু সংসারের কাজ আবার কাজ! কলকাতার সেই মস্ত সংসারের শুধু দুধ জলখাবারও যে এ খাটুনির চতুগুণ! নাঃ! এবার থেকে জোর করেই প্রত্যেক বছর বেরিয়ে পড়বে সুজাতা!
সেই সেদিন রান্না করতে করতে এই কথাই ভাবছিল সুজাতা। যে দিনটাকে এখন তার স্লেটের লেখার মতো মুছে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
সুমনা এসে দাঁড়িয়েছিল।
সুজাতা চমকে আর শিউরে বলে উঠেছিল, ও কী?
সুমনা দ্রুত ব্যস্ততায় বলে উঠেছিল, একটা বাচ্চা! রাস্তায় পড়ে ছিল। শিগগির একটু গরম দুধ আর অনেকটা ঘেঁড়া ন্যাকড়া আনো না মা, দেরি করলে নিশ্চয় মরে যাবে।
সুজাতা কিন্তু নির্দেশ পালনের লক্ষণ দেখায়নি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কটু কণ্ঠে বলেছিল, মানুষের বাচ্চা না কুকুর বেড়ালের?
বলেছিল অবশ্য সত্য নির্ণয়ের জন্যে নয়, বাচ্চাটা যে মানুষের, তা তার দেখা হয়ে গিয়েছিল। এটা নিতান্তই মেয়ের নির্বোধ দুঃসাহসকে ধিক্কার।
সুমনা আরও দ্রুততায় বলেছিল, কী আশ্চর্য! দেখতে পাচ্ছ না? দোহাই তোমার মা, রাগটা পরে দেখিও, আগে একটা ছেঁড়া শাড়ি কি চাদর দাও। এর গায়ে জড়ানো ন্যাকড়াগুলো বড় বড় কাঠপিঁপড়েয় ভর্তি।
সুজাতা তবু কঠিন মুখে বলেছিল,ছেলেকে যারা কাঠপিঁপড়ের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে চলে যায়, তারা কী, তা অবশ্য বোঝবার বয়েস হয়েছে তোমার? সেইটা তুমি নিজে হাতে করে কুড়িয়ে আনলে?
বাঃ নিজের হাত ছাড়া পরের হাত তখন পাচ্ছি কোথাও বেড়াতে বেড়াতে সেই কোথায় চলে গিয়েছিলাম জানো? যাকগে তুমি আগে দুধ আর ন্যাকড়া দাও বাবা, মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষে পাক এটা। তারপর যত পারো বোকো। জলদি জলদি মা।
বাধ্য হয়েই সুজাতাকে তখন মেয়ের আদেশ পালন করতে হয়েছিল। যেরকম করছিল সুমনা, ভয় হচ্ছিল সত্যি না ওর বুকের মধ্যেই মরেটরে যায় বাচ্চাটা। ফরসা দুখানা শাড়ি, আর একটু গরম দুধ এনেছিল সুজাতা।
কিন্তু সুমনা যখন বাচ্চাটার গায়ে কাপড়-চোপড়গুলো ফেলে দিয়ে পিঁপড়ে ঝেড়ে মায়ের সেই পুরনো শাড়ি দুখানা দিয়ে জড়িয়ে বাগিয়ে ধরে মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দুধটা তো বাপু তোমাকেই খাইয়ে দিতে হবে। আমার সাহস হচ্ছে না–
তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না সুজাতা। তীব্র স্বরে বলে উঠল,আমি খাইয়ে দেব? এই সন্ধেবেলা রাঁধতে রাঁধতে ছোঁব ওকে?
ছোঁবে না!
ছোঁব? বললি কী বলে?
বাঃ এখানে তো আর ঠাকুমা জেঠিমা নেই—
ঠিক এই কথাটাই সুজাতা কেবলই বলেছে মেয়েকে।
এখানে আর মুরগির ডিম সেদ্ধ করে দেব না কেন? এখানে তো আর তোর ঠাকুমা জেঠিমা নেই। কিন্তু এখন সেই সুযোগের উল্লেখে জ্বলে উঠে বলে, তা না হয় নেই। তা বলে আমিই কি একেবারে হাড়ি ডোম? একে তো ওটি কী নিধি তার ঠিক নেই, তা ছাড়া আঁতুড়ে ছেলে তো বটে–
থাক, তবে থাক! সুমনা বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিল, সব সমান! একটা প্রাণী মরছে, সে কথা চুলোয় গেল, ছোঁয়া, নাওয়া এইটাই বড় হল। বেশ, ঠিক আছে, আমিই যা পারি করছি। দুধটা দেবে তো, না কি ও কী নিধি তার বিচার করতে বসবে?
হ্যাঁ, সেদিন এইরকম ঝংকারই দিয়েছিল সুমনা। যা তার চিরকালের স্বভাব। বাড়িসুদ্ধ সকলের আদরের মেয়ে, কথাবার্তায় একটু বেপরোয়া বরাবরই। এখন সে সুমনা বদলে গেছে।
কিন্তু তখনও বদলায়নি।