এ বুদ্ধি সিদ্ধার্থর।
আর বুদ্ধিটা জোরালো।
পিতৃহৃদয়ের আকুলতাটা প্রকাশ পেল। সুমনা ফুডের বোতলটা প্রায় ছিনিয়ে নেয় অলকের হাত থেকে। মুখে ধরে ছেলেটার।
আর সন্দেহের কী থাকতে পারে!
তবু চলে টানাটানি।
ঝগড়ার কারণটা কী?
সিদ্ধার্থ সহসা হেসে ওঠে। বলে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কি আর কারণ থাকে মশাই?
তবু। বাড়ি থেকে চলে আসার মতো
ওটা মুডের ব্যাপার।
যাক শেষ পর্যন্ত সুমনার সাক্ষ্যেও গরমিল হল না। সমস্ত দৃশ্যটার ওপর চোখ বুলিয়েই ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে নিতে পেরেছিল সে।
বাপ, ভাই আর স্বামী।
ঠিকই তো৷
রাগ! হ্যাঁ রাগ করেই বটে। রাগের কারণ? নেহাত তুচ্ছ।
তুচ্ছ কারণে আপনি এইভাবে বাড়ি থেকে চলে আসতে সাহসী হলেন?
চলে আসা আবার কী? এখন সুমনা জোরালো–এখানে আমার এক সহপাঠিনীর বাড়ি আছে–
সহপাঠিনী!
তার মানে পড়ুয়া মেয়ে।
স্টুডেন্ট আপনি?
হ্যাঁ।
হ্যাঁ, বি. এ. পাশ করে বেরিয়েছে এবার। এম. এ. পড়ার প্রস্তুতি চলছে। বাপ হাইকোর্টের উকিল।
ও বাবা! যেতে দাও যেতে দাও। তবু–মরণ কামড়!
কিন্তু আগে তো ওই সহপাঠিনীর কথা বলেননি?
রাগ করে বলিনি। আপনারা ধরলেন কেন?
হু, রাগটা আপনার একটু বেশি। হিতাহিত জ্ঞান হরে নেয়। নাম ঠিকানা কী সহপাঠিনীর?
কী দরকার আপনার?
আছে দরকার।
লিখে নিন। দীপা সান্ডেল। শ্রীরামপুর, সান্ডেল পাড়া।
শেষ পর্যন্ত খোলা বাতাসে।
লিখুক না, লিখে নিক। খুঁজুক গিয়ে।
ছেলেটাকে কোলে নেয় সিদ্ধার্থ। হাত বাড়িয়ে।
আর ভাগ্যের দয়া, আদৌ আপত্তি করে না সে। হয়তো এতক্ষণের বন্দিত্বের পর মুক্তির বাতাস পেয়ে। না কি শিশুহৃদয়ের সহজাত বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছে সে, এখানে আশ্রয় আছে।
সুমনাও দিয়েছে সেই প্রসারিত হাতের ওপর।
সুমনা বিশ্বাস করে কাউকে ছেলে দেয় না। সুমনা এগিয়ে দিয়েছে নির্ভয় নির্ভরতায়।
.
উঃ!
গাড়িতে উঠতে উঠতে বেশ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে সিদ্ধার্থ, সামান্য ব্যাপার নিয়ে কী কাণ্ডটাই করলে! বাড়িসুষ্ঠু লোকের ঘাম ছুটিয়ে দিলে একেবারে!
অলক উঠে পড়ে বলে, যা বলেছ! খেতে পাইনি সারাদিন!
খেতে তো আমরাও কিছু পেলাম না মশাই, রেলপুলিশ বলে, আপনি তো স্ত্রী পেলেন, ছেলে পেলেন।
সিদ্ধার্থ পকেটে হাত পুরে বলে,ও হ্যাঁ হ্যাঁ।
কান্তিকুমার গাড়িতে ওঠেন না।
কান্তিকুমার ট্রেনে যাবেন।
অলক যাবে গাড়ি চালিয়ে।
অলক পারবে? তা আবার পারবে না?
কান্তিকুমারের চেয়ে ভাল পারবে। কান্তিকুমার বড় বেশি টায়ার্ড।
.
বেশি রাতের নির্জন রাস্তা!
অলক গাড়ি চালাচ্ছে নিঃশব্দে, সহজ মসৃণতায়। সময়ের মসৃণতায় মুহূর্তগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
বাচ্চাটা পেটভরে খেতে পেয়ে গাড়ির দোলানিতে ঘুমিয়ে অচেতন। সুমনারও বুঝি কোনও চেতনা নেই। ও ভুলে গেছে বড় ক্লান্ত হয়ে কখন যেন একবার মাথাটা হেলিয়ে সিদ্ধার্থের কাঁধে রেখেছিল, আর তেমনিই রেখে বসে আছে।
সিদ্ধার্থ এক সময় আস্তে আস্তে বলে, তোমার সংসার আমি সাজিয়ে রেখেছি সুমনা! আমার বুদ্ধিতে যা কুলিয়েছে, সব কিনে কিনে জড়ো করেছি, শুধু–
সিদ্ধার্থেরও লজ্জা আছে।
সিদ্ধার্থও কথা বলতে গিয়ে থামে?
সুমনা ঘাড় সোজা করে চোখ তুলে তাকায়। সেই তাকানোর মধ্যেই রয়েছে প্রশ্ন। সে প্রশ্ন যেন নরম সুরে বলছে, শুধু কী?
শুধু একটা জিনিস বাকি রেখেছি। কেনাটা তুলে রেখেছি দুজনে মিলে কিনব বলে।
এবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন আসে।
কী? কী জিনিস?
মাথাটা নিচু করে অলকের কান বাঁচিয়ে আস্তে বলে সিদ্ধার্থ, দোলনা! একটা বেতের দোলনা!
দোলনা!
দোলনা কিনবে তারা দুজনে মিলে! বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় সুমনা। ব্যাকুল একটা হাতে হাত চেপে ধরে সিদ্ধার্থর।
সিদ্ধার্থ সে হাতকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলে, হ্যাঁ। পালা করে দুজনে দোল দেব ব্যাটাকে।
সিদ্ধার্থ!
হ্যাঁ। ও থাকবে আমাদের কাছে, আমাদের দুজনের কাছে। এত চমৎকার একটা সমাধান হাতের কাছে ছিল, অথচ কত হাতড়েই বেড়াচ্ছিলাম! আশ্চর্য নয়? তুমি একটা কোথাকার কার ছেলেকে এত ভালবাসবে, এও অসহ্য! তাই বেশ গুছিয়ে একটা দাবি খাড়া করে ফেলেছি। নিজের বলেই চালাতে শুরু করেছি।
সিদ্ধার্থ!
কী, রাগ হল নাকি! কেন, চেহারাটা কি আমার এতই খারাপ যে, আমাকে তোমার ওই রাজপুত্রটির বাপ বললে বেমানান হবে?