আশ্চর্য, পথের দুধারে তো লোকের বসতি আছে। একটা ছোট ছেলে যে কেঁদে হন্যে হয়ে যাচ্ছে, কারও কানে যাচ্ছে না? কেউ একবার ঘরের জানলা খুলে বাড়ির দরজা খুলে বলতে পারছে না, এ কী এত কাঁদছে কেন?
সুমনা আশ্চর্য হতে পারে।
সুমনা জগতের কী জানে?
পৃথিবীর কতটুকু দেখেছে সে?
সুমনা কি জানে অহরহ এ কান্না শুনতে শুনতে কানে ঘাঁটা পড়ে গেছে পৃথিবীর! ক্ষুধার্ত শিশুর দুরন্ত কান্না, তার গা সহা!
.
এই তো স্টেশন। নেমে পড়ল সুমনা। উদ্দাম ক্রন্দনরত ছেলেটাকে রিকশাওলাটারই কোলে দিয়ে বটুয়া থেকে পয়সা বার করে দিল।
যে বটুয়াটা সম্বল করে এসেছে সুমনা। ভাগ্যিস শুধু এইটুকু জ্ঞান তার ছিল যে, এই বিশ্ব সংসারে টাকাটাই মূল জীবনীরস!
কোথায় তোমাদের স্টেশনমাস্টার?
ওই তো ইদিকেই আসছে, লোকটা বলে।
আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি এগিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী ইনস্পেক্টরকে উদ্দেশ করে বলেন, এই তো, এই ইনিই তো ঘণ্টাতিনেক আগে
পৃথিবীটা কত বড়, দেখা হল না।
তার আগেই সন্ধানী পুলিশ দেখে ফেলল সুমনাকে।
এখানে বসে ছিল এরা।
কান্তিকুমার, সিদ্ধার্থ, অলক।
রেল-পুলিশের টেলিফোন পেয়ে যারা সুমনা ফেরার আগেই এসে পৌঁছে গেছে।
পুলিশ যা প্রশংসনীয় কাজ করল, তার তুলনা কী?
এই যে এদিকে আসুন। দেখুন দিকি—
আমি! আমি যাই! দৃঢ়স্বরে বলে সিদ্ধার্থ, সন্দেহের সৃষ্টি হবে না তাতে।
কান্তিকুমার মোটা চশমার ভিতর থেকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,তাতে সন্দেহের সৃষ্টি হবে না?
না। আপনি বুঝে দেখুন কাকাবাবু। স্ত্রী পুত্র এই পরিচয়ই সবচেয়ে সন্দেহহীন। আমার স্ত্রী আর পুত্র। স্ত্রী আমার সঙ্গে ঝগড়া করে ছেলে নিয়ে চলে এসেছে।
পুলিশ তাই বিশ্বাস করবে? স্বভাববহির্ভূত তীব্ৰস্কর কান্তিকুমারের
করবে। নিশ্চয় করবে, সিদ্ধার্থ ব্যগ্রভাবে বলে, যদি আপনি সহযোগিতা করেন, যদি আপনি সে পরিচয় অস্বীকার না করেন।
কান্তিকুমার আজ অবোধ হয়ে গেছেন, দিগভ্রান্ত হয়ে গেছেন, তাই সিদ্ধার্থ তাঁকে বোঝাতে আসছে, কোন জবাবটা সন্দেহহীন হবে, কীভাবে কথা ফেললে পুলিশ বিশ্বাস করবে।
হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট কান্তিকুমারকে!
হাতি আর ব্যাঙের প্রবাদটা তা হলে মিথ্যে নয়?
কিন্তু কান্তিকুমার বুঝি তাঁর মেয়ের উপর সিদ্ধার্থের ওই আধিপত্য বিস্তার সহ্য করতে পারছেন না। না কি এই ভয়ংকর একটা লজ্জার বিপদে পড়ে সত্যিই অবুঝ হয়ে গেছেন?
তাই আবার বিচলিত কণ্ঠে বলেন, পুলিশ মানেই বোকা নয় সিদ্ধার্থ, বিবাহিতা অবিবাহিতা বোঝার ক্ষমতা ওদের আছে।
হঠাৎ অলকও বলে ওঠে, তা সত্যি, সিঁদুর টিদুর কিছু নেই—
পাগলামি করিসনে। সিদ্ধার্থ বলে, সিঁদুর আজকাল অনেকেই পরে না। আর হিন্দু বিয়ের এই একটা সুবিধে, কাগজেপত্রে পাকা প্রমাণ দেখাতে হয় না। বিশ্বাসভাজন সাক্ষী দুএকজন থাকলেই হল। তা বাবা আর দাদা, এই চাইতে উপযুক্ত বিশ্বাসভাজন সাক্ষী আর কে হতে পারে? আপনারা বলবেন–
.
গাড়ি নিয়েই এসেছে, মস্তবড় মোটরগাড়ি।
এসেছে বাপ, ভাই আর স্বামী!
নিজেরাই যারা খবর দিয়েছে, আর মেয়ে খুঁজতে যারা হন্যে হয়ে এসেছে। আর এসেছে এতবড় গাড়ি চড়ে। তাদের খুব বেশি হয়রান করে না পুলিশ। হয়তো বা করত, যদি শুধু একটা বেওয়ারিশ তরুণী মেয়ে হত!
কিন্তু না। এর অনেক ওয়ারিশান। আর সঙ্গে একটা ক্ষুৎপিপাসায় বিদ্রোহী, উদ্দাম, চিৎকারপরায়ণ বাচ্চা ছেলে। আটকে রাখতে চাওয়া মানেই নিজেদের জীবন মহানিশা করে তোলা। তাই ছেড়ে দিতে দেরি করে না।
তবু জেরার অভিনয় একটু করে বইকী!
বলে, ওঁর মুখ থেকে তো একটাও কথা আদায় করতে পারিনি, ব্যাপারটা কী বোঝান আমাদের।
প্রধান ব্যাপার মাথাটা একটু ইয়ে-বলে ওঠে অলক।
প্রশ্নকারী তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আপনি ওঁর কে?
দাদা।
ওঃ দাদা! থাক, আপনার এখন কথা বলবার দরকার নেই। বাবাকেই বলতে দিন। হ্যাঁ আপনি কী বলছেন?
কান্তিকুমার তেমনি গম্ভীর শান্তকণ্ঠেই বলে যান, খুব একটা কিছু ঘোরালো ব্যাপার নয়। শুনছি তুচ্ছি কথা কাটাকাটি থেকেই
আপনার মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না?
ছিল।
মেয়ের মাথায় কোনও
না। শুধু একটু রাগী বেশি।
কতদিন বিয়ে হয়েছে?
বছর দুই।
হু। ঠিক আছে।…আপনার কিছু বলবার আছে? সিদ্ধার্থের দিকে তাকায় সে মর্মভেদী দৃষ্টি হেনে।
সিদ্ধার্থ কান্তিকুমারের মতো স্তিমিত নয়, শান্ত নয়, ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পিত মূর্তি নয়।
সে চটপট বলে ওঠে, বলবার কিছু নেই মশাই, একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন দয়া করে–ছেলেটা খেতে না পেয়ে চিল্লাচ্ছে।
কেন, মায়ের কাছে খেতে পায় না?
প্রশ্নকারীর স্বর তীক্ষ্ণ।
কিন্তু সিদ্ধার্থ সপ্রতিভ।
ওসব কথা বাদ দিন না মশাই, মায়ের কাছে আবার কোন ছেলেটা খেতে পাচ্ছে এ যুগে? জন্মাবধি ফুড কিনতে কিনতে তো
আপনারা তো বলছেন হিন্দু। হিন্দু বাঙালি। উনি লোহা সিঁদুর ইত্যাদি ব্যবহার করেন না কেন?
কেন আর! ফ্যাশান! কিন্তু সব কিছুর আগে বাচ্চাটাকে একটু খাওয়াতে দিলে ভাল হত না? ওর খাদ্যটা যখন এসেই গেছে–
এসে গেছে!..সুমনা চমকে তাকায়। বলে ওঠে, কই? কোথায়?
হ্যাঁ, এই যে!…অলক—
অলক তার হাতের ব্যাগ থেকে একটা তৈরি ফুড ভর্তি ফিডিং বটল বার করে দেয়। যেটা আসার আগে সুজাতা করে দিয়েছে।