শুধু সুমনাকেই রচনা করে চলতে হবে সহস্র মিথ্যার জাল।
না করে উপায় নেই।
সত্যি কথা কেউ শুনতে চায় না, বুঝতে পারে না। সত্যি কথাকে হজম করবার ক্ষমতাই নেই। কারও। সরাসরি সত্যিকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখলে থতমত খাবে। আহত হবে।
ওদের বাঁচাবার জন্যেই মিথ্যার জালের দরকার। ওরা সেই বানানো মিথ্যা শুনে সন্দেহ করবে, মুখ বাঁকাবে, মুচকি হাসবে, তবু সেটাই হজম করতে পারবে।
কিন্তু দীপার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে কোন মিথ্যার মাধুরী রচনা করে?
দীপা!
তার সহপাঠিনী।
যাকে সুমনা বলত, ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে পড়া! বাস্য! তোর মতো অবস্থা আমার হলে, স্রেফ খাতা থেকে নাম কাটিয়ে দিয়ে বাড়ি বসে কুটনো কুটতাম বাটনা বাটতাম!
সেই দীপা।
যে সুমনার সৌভাগ্যর দিকে করুণ নয়নে তাকাত। যে বলত, তা তুই আর বলবি না কেন? ভগবান তোকে জগতের সব সুবিধেগুলো একঙ্গে ঢেলে দিয়েছেন। আমাদের তো খেটেপিটে মানুষ হতে হবে? বেঁচে থাকতে হবে?
আজ সুমনার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকাবে দীপা? যে সুমনাকে খেটে-পিটে শুধু নিজেকেই বাঁচিয়ে রাখলে চলবে না। আরও একটি প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, মানুষ করতে হবে।
দীপা যদি বলে, এ কী, তোর এ কী হাল?
তার উত্তরে কী বলবে সুমনা?
কী বলবে, ভাবতে ভাবতে শ্রীরামপুর এসে গেল।
ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।
কিন্তু এই রাত্তিরে এই ঘুমন্ত ছেলে নিয়ে বন্ধুর বাড়ি? তার তো মা বাপ আছে, সে তো একা নয়!
তবে কী করবে সুমনা?
ঠিকানাও তো জানা নেই।
শুধু নাম।
কোনও রিকশাওলা চিনবে দীপা সান্ডেলের বাড়ি?
ওঃ সান্ডেল বাড়ি যাবেন?
বলল একজন সবজান্তা।
তা অনেক পথ পার করে সারা টাউনটা ঘুরিয়ে নিয়েও গেল কোনও এক সান্ডেল বাড়ি। কিন্তু ডাকাডাকিতে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনি দীপা সান্ডেল নাম্নী কাউকে না জানলেও, জেরায় সুমনার সমস্ত কিছু জেনে ফেলবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন।
তাঁর জেরার হাত এড়িয়ে ছাড়ান পেতে সময় লাগল।
অগত্যা সেখান থেকে বিদায়।
সাইকেল রিকশাওয়ালা দয়াপরবশ হয়ে বলে,ঠিকমতন ঠিকানা না জেনে কি এত রাত্রে আসতে আছে দিদিমণি? আমি বলি কি, আপনি আজকের মতন ফিরে যান। ট্রেন এখনও আছে। কাল আবার তখন–কোনও বেটাছেলেকে সঙ্গে করে
থাক তোমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না। ধমকে ওঠে, সুমনা, কখন তোমাদের লাস্ট ট্রেন?
আজ্ঞে এগারোটা পঁয়তাল্লিশ।
রাগের মাথায় হাতের ঘড়িটাও হাতে বেঁধে নেওয়া হয়নি। যেটা নিতান্তই দরকার ছিল।
এইসব নিচু ক্লাশের লোকেরা যখন মুরুব্বিয়ানা করতে আসে, তখন তাদের ধমক দিয়ে দাবিয়ে দেওয়াই ঠিক; তাই ধমকে ঠাণ্ডা করে দিতে উদ্যত হয় সুমনা, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলেটা জেগে উঠে পরিত্রাহী চিৎকার জুড়ে দেয়।
আর সেই কান্না ভোলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সুমনার মনে পড়ে, সাত আট ঘণ্টা ছেলেটা কিছু খায়নি। হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিংরুমে সেই যা খাওয়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বসে খানিক খানিক সময় বাদ শুধু জল খাইয়েছে। এখন কটা ঘণ্টা জলও নেই।
ঘুমিয়ে পড়েছিল।
খিদেয় আর খেলার ক্লান্তিতে।
জেগে উঠে রসাতল করতে চায়।
ভোলাবার ব্যর্থ চেষ্টায় কাঁদো কাঁদো হয়ে সুমনা বলে, এই শোেনন। দুধ পাওয়া যাবে কোথাও?
দুধ!
লোকটা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত সুরে বলে, এত রাতে দুধ কোথা?
দুধ কোথা? সুমনা ধমকে ওঠে, বলতে চাও বাচ্চাটা না খেয়ে মারা যাবে?
আজ্ঞে আমি কী করব? ছেলের দুধ সঙ্গে নেই?
না নেই। থাকলে তোমায় বলা হত না।
কিন্তু কথা কার কানে যাচ্ছে?
ছেলেটা যেন শত্রুতা সাধার ভূমিকা নিয়েছে।
সুমনা কী করবে?
সুমনা কি ওকে ঠাস করে একটা চড়িয়ে দেবে?
সুমনা কি নিজে হাউহাউ করে কাঁদবে?
সুমনা কি আশপাশের কোনও বাড়ির দরজায় করাঘাত করে বলবে, একটু দুধ দিতে পারেন? একটু দুধ? বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে
ভাষাটা কী রকম শোনাল? ঠিক রাস্তার ভিখিরির মতন না?
ভাবতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সুমনা।
তা হলে সুজাতার কথাই ঠিক? ছেলে নিয়ে ভিক্ষেই করতেই হবে তাকে? মাত্র এই ঘণ্টা কয়েক বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে চলে এসেছে সুমনা, এর মধ্যেই ভিক্ষাবৃত্তির ভাষা মুসাবিদা করছে?
এই নোটটা তোমায় দিচ্ছি–সুমনা বলে, যেখান থেকে হোক একটু দুধ এনে দিতে হবে।
ব্যাপারটা যে গোলমেলে, তা বুঝতে দেরি হয় না লোকটার। সে দ্রুতবেগে গাড়ি চালাতে চালাতে বেজার মুখে বলে, নোট নিয়ে কী করব? এখন দুধ পাওয়া যাবে না। আপনি বরং স্টেশনে চলে যান। মাস্টারমশাইকে বলে যদি কিছু ব্যবস্থা হয়–
স্টেশনমাস্টারকে দিয়ে দুধের ব্যবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা যে কতখানি, সে কি আর জানে না সুমনা?
তবু ভাবে, যাক, স্টেশনে তো চায়ের দোকান থাকে, রাত অবধি খদ্দেরও থাকে তাদের। সেখানেই যদি–
সে দুধ আদৌ দুধ কি না, সে দুধ খেলে ছেলের পেটের অসুখ করবে কি না, দুধ পেলে খাওয়াবে কীসে করে, এসব কথা কিছু ভাবছে না সুমনা। শুধু ওর সমস্ত একাগ্রতা, সমস্ত ইচ্ছাশক্তি ঝিনুক কয়েক দুধের স্বপ্নের কাছে মাথা খুঁড়ছে।
না, চিন্তাশক্তি এখন নেই সুমনার। থাকলে হয়তো ভাবত, ভাগ্য কত সহজেই মানুষকে নতিস্বীকার করায়। বুঝতে পারত ভদ্রঘরের মেয়েরা এত সহজে ভিক্ষার হাত বাড়ায় কেন? শিশু, শিশুই হচ্ছে সমস্ত নিরুপায়তার মূল।