বুড়ি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই সবিস্ময়ে বলে,ওমা, ছিরামপুর যাবে তো সেই এস্তক বসে কেন? দু দুখানা গাড়ি তো ছেড়ে দিল।
ছেড়ে দিল!
আর নেই গাড়ি?
থাকবে না কেন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় আছে। তুমি একা যাচ্ছ বুঝি?
সেখানে স্টেশনে লোক থাকবে।
এবার থেকে অহরহই মিথ্যা বলতে হবে সুমনাকে। মিথ্যার জাল রচনা করেই কাটাতে হবে জীবন।
বুড়ি বলে, ছেলেটি বুঝি প্রথম?
হ্যাঁ।
খাসা গোপালের মতন চেহারাখানি! তা যাই বলো বাছা, দুরন্ত ছেলে নিয়ে এমন একা যাওয়া আসা করা ঠিক না। বড় ভয়। আর কাউকে নিতে হয় সঙ্গে।
সুমনা তীব্রস্বরে বলে ওঠে, বাড়িতে আর যদি কেউ না থাকে?
অ। কেউ নেই বুঝি? মনে কিছু কোরো না বাছা, বুড়োমানুষ কী বলতে কী বলি। তবে যাবে যদি উঠে পড়ো। এই আবার একটা ট্রেন ছাড়বে।
সুমনা উঠে যায়।
কেউ চুপ করে থাকবে না।
সবাই কথা বলবে। তোমার নিভৃতে যে কথাকটি মনের মণিকোঠায় তুলে রাখতে চাও, সেই কটিকে পেড়ে নামানোতেই আনন্দ সবাইয়ের।
একটা কথাহীন পৃথিবী খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে সুমনা নিশ্চিন্ত হয়ে জীবনটা কাটাতে পারে?
সে-পৃথিবীকে আবিষ্কার করতেই হবে।
কিন্তু ওরা যদি খুঁজে বার করে?
সুমনা স্টেশন থেকে বাড়িতে ফোন করবে। জানিয়ে চলে যাবে। বলে যাবে, আমায় খুঁজো না।
.
কিন্তু খুঁজো না বললেই কি না খুঁজে থাকবে এরা? বাপ, ভাই প্রেমিক?
কলকাতা যেমন বড় শহর, তেমনি হাতের মুঠোর শহর।
রেলপুলিশকে জানাতেই বা কতক্ষণ? রেলপুলিশেরই বা জানতে কতক্ষণ? শেষ অবধি ওরকম একটি কে-এর খবর দিয়ে দেয় তারা।
এবার বর্ণনাটা নিখুঁত দেওয়া হয়েছিল এদের কাছে। রং গড়ন উচ্চতা, নাম ধাম বয়েস। দেওয়া হয়েছিল সঙ্গের বাচ্চাটির বিবরণ।
শ্রীরামপুর স্টেশন।
কী ভেবে ওখানে গেল সুমনা? এমন কে আছে ওর ওখানে?
না, তেমন কেউ নয়।
তবু ভেবেছিল দীপার কাছে আগে যাবে।
তারপর গুছিয়ে নেবে।
তারপর দেখবে পৃথিবীটা কত বড়।
ভেবেছিল সুমনা। সারাদিন হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিংরুমে বসে ভেবেছিল। বাড়িতে বাথরুমের বারান্দা থেকে জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতেও ভেবেছিল, একবার এদের চোখের আওতা থেকে চলে যেতে পারলে হয়! তারপর দেখব।
সুজাতা বলেছিল, ছেলে কোলে করে রাস্তায় ভিক্ষে করিস, তা ভিন্ন আর কী গতি হবে তোর।
সুমনা দেখবে আর কোনও গতি হয় কি না।
এতবড় বিরাট পৃথিবীতে কখনও কি কোনও সত্যি-মা এমন করে শিশু বুকে চেপে রাস্তায় নামে না? সুমনা মিথ্যে মা, কিন্তু সুমনার ভালবাসাটা তো মিথ্যে নয়?
আর সুমনার জেদ!
সুমনার জেদের অহংকার।
যে অহংকার দেখিয়ে দিতে চায় পথে পথে ভিক্ষে করা ভিন্ন আর কোনও পথ আছে কিনা।
সারাটা দিন বৃথা ভাবনায় কাটিয়েছে সুমনা। সামান্য একটা ড্রাইভারের ঔদ্ধত্যে ভেবেছে সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি উদ্ধত দৃষ্টি মেলে উদ্যত হয়ে আছে অপমান করবে বলে। তা কেন? পৃথিবী অনেক বড়!
সুমনা একদিন ওর ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলে, নিয়ে গিয়ে দাঁড়াবে ওদের সেই বাড়িতে। ঢুকবে জমাদার আসার চোরা সিঁড়ি দিয়ে নয়, সদর দরজা দিয়ে। সুমনার সেই অহংকারী মাকে বলবে, শোনো, শুনে যাও, আমি ভিক্ষে করিনি, আমি সম্মান হারাইনি। আমি আমার ছেলেকে মানুষ করে তুলেছি।
ভয়ানক একটা উত্তেজিত মানসিক অবস্থায় কোনও পরিকল্পনা দাঁড়ায় না। তবু আকাশের গায়ের দ্রুত চলন্ত মেঘের মতো চিন্তাভাবনাগুলো ছুটোছুটি করে।
বি.এ. পাশের ডিগ্রিটাকে সম্বল করে কোনও মফস্বলের স্কুলের টিচারির জন্যে দাঁড়ালে, দাঁড়ানোটা ব্যর্থ হবে না। মাস্টারি একটা ঠিকই জুটিয়ে নিতে পারবে। আর মাস্টারি-ই একমাত্র পেশা, যাতে ছুটি আছে অনেক।
গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটি, এই দুটো বড় ছুটিতে অচিনকে সে যত্নে ডুবিয়ে রাখবে। খুচরো ছুটিও তো আছেই। বাকি সময়টার জন্যে রাখতেই হবে একটা ঝি। উপায় নেই। কিন্তু? হঠাৎ চমকে উঠল সুমনা, যদি সুমনার অনুপস্থিতির অবকাশে সেই ঝিটা অচিনকে চুরি করে নিয়ে পালায়?
ভয়ে হৃৎপিণ্ডটা ঠাণ্ডা হয়ে এল সুমনার। ছেলেটাকে অকারণেই আরও চেপে ধরল।
অথচ এমন চাপাচাপির মধ্যে থাকতে সে একান্ত নারাজ। ট্রেনের কামরায় বেদম দৌরাত্ম্যি করবে সে।
কী সুন্দর ছেলেটি আপনার!
বলল একটি সহযাত্রিনী। লেডিস কম্পার্টমেন্টটাই বেছে নিয়েছে সুমনা। সহযাত্রিনী ফের বলে, একা এত দুরন্ত ছেলে নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন?
সুমনা গম্ভীর ভাবে বলে, না। পাশের গাড়িতে এর বাবা আছে।
এর বাবা! মেয়েটি হাসে,আপনার কেউ নয় তো?
না! আমার কেউ না।
বলে সুমনাও হাসির ভান করে।
হয়তো আর বেশিক্ষণ থাকলে মেয়েটির কৌতূহল আরও প্রবল হত, হয়তো বলে বসত, আপনি বুঝি সিঁদুর চিঁদুরকে কুসংস্কার ভাবেন?হয়তো বলত, কই এর বাবা তো একবারও খোঁজ নিতে এলেন না? কিন্তু ঈশ্বরের অপার অনুগ্রহ, মেয়েটা কোন্নগরে নেমে গেল।
আর সুমনা ভাবতে লাগল।
খুব অবলীলায় মিথ্যে কথাটা বলে ফেলতে পারল সে। একটুও বাধল না, বা ওর প্রশ্নের উত্তরে বলে উঠতে পারল না, তা একা ছাড়া গতি কী? এটা যে আমার কুড়োনো ছেলে!
সহজেই বলল পাশের গাড়িতে এর বাবা আছে। তা হলে পারবে সুমনা অবিরত মিথ্যার জাল রচনা করতে।
কে বলতে পারে সত্যিই আছে কি না!
হয়তো আছে। এই গাড়িতেই ওর মা কিংবা ওর বাবা আছে। তারা নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে বসে আসে। তাদের আর মিথ্যা কথা বলতে হবে না।