বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল!
শেয়ালদা নয় হাওড়া! পাগল নাকি!
বয়েস মারাত্মক, সঙ্গে একটা কচি ছেলে।
বাঙালি ড্রাইভার রিস্ক নিতে রাজি হয় না। বলে,ঠিক আছে, অন্য গাড়ি দেখে নিন না।
না। সময় নেই!
ড্রাইভার বেঁকে বসেছে। যাবে না।
কাঠকবুল। কিছুতেই না।
অন্য গাড়ি নিন না। অভাব তো নেই।
তা আপনারই এত আপত্তি কীসের? অমনি তো যাবেন না, পয়সা দেব তো?
পয়সা!
পয়সা দেখাতে এসেছেন!
ড্রাইভারি করছি বটে, কিন্তু আমরা ভদ্রলোকের ছেলে। আমাদের পয়সা দেখাতে আসবেন না।
বেশ তো আপনারা ভদ্রলোকের ছেলে, সেটা তো মস্ত একটা সুবিধে আমাদের। ভদ্রঘরের মেয়ের সুবিধে অসুবিধে অবশ্যই দেখবেন।
না। আমার মিটারটা মিটিয়ে দিন।
সুমনা এবার চোখ গরম করে।
এভাবে আমাকে নামিয়ে দিতে আপনি পারেন না। পাবলিকের প্রয়োজন আপনাকে দেখতেই হবে।
মাপ করবেন।
গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়েছে ও।
অগত্যাই নামতে হল সুমনাকে।
আর হঠাৎ মনে হল, টাকা থাকলেই কি সব হয়? বজায় থাকে মান মর্যাদা? সামান্য একটা গাড়ির ড্রাইভার! সেও এমনভাবে অপমান করল কেন তবে? কই প্রতিকার তো নেই সুমনার হাতে!
বাড়িতে প্রতিপদেই মনে হয়েছে, অপমানিত হচ্ছি। এতটুকু এদিক ওদিক হলেই মনে হয় আর, আর না। চলে যাব।
চলে যাব। মান মর্যাদা বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
যেন সমস্ত বাইরেটা সম্মানের রাজ-সিংহাসন পেতে বসে অপেক্ষা করছে।
এই তো তার প্রমাণ।
আর এই তো তার শুরু।
এরপর যখন চাকরির চেষ্টায় ঘুরবে? কে জানে কত অপদস্থ হতে হবে। হয়তো ছেলে সম্পর্কে প্রশ্নের আর শেষ থাকবে না। হয়তো তারা মন্তব্য করবে কটু। হয়তো বলবে, না না ওরকম একটা দুধের বাচ্চা সমেত শিক্ষয়িত্রী আমরা রাখি না।
বিধবা?
তাতে কি, ছেলের বাপের একটা নাম পরিচয় তো ছিল।
বানাবে সুমনা?
যা খুশি?
তাতেই কি অপমানের হাত থেকে রেহাই পাবে?
তা যদিই বা রেহাই পায়, ত্রুটি তো হবেই প্রতিপদে। একজন কুমারীর চেয়ে, একজন পরিবারের গণ্ডির মধ্যকার বিবাহিতা মেয়ের চেয়ে। অসুখ করতে পারে ছেলের, আবদার করতে পারে। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাতে পারে।
শিউরে উঠল সুমনা।
কিন্তু সেই ত্রুটির খেসারত ত দিতে হবে তাকে নীরবে গঞ্জনা খেয়ে। হয়তো ওরা বলবে, আপনার দ্বারা চলবে না।
সুমনাকে মিনতিতে ভেঙে পড়ে বলতে হবে, দেখুন আমার না হোক, এই বাচ্চাটার মুখের দিকে চান একবার! চাকরি গেলে, কী খেতে দেব ছেলেটাকে?
যে সুমনা বাড়িতে কারও এতটুকু কথা সইতে পারে না, বাবার নয়, মায়ের নয়, জেঠি জ্যেঠা কাকা কাকি ঠাকুমা পিসিমা, কারও কথা নয়, সেই সুমনা!
না, স্বাবলম্বন মানেই সসম্মান জীবন নয়। সেই অবলম্বনটুকু রক্ষা করতেও ক্ষেত্র বিশেষে অসম্মান বহন করতে হয়!
.
হাওড়ায় এসে পৌঁছল।
গিয়ে বসল থার্ড ক্লাসের ওয়েটিং রুমে।
এই ভাল। সুমনার পরিচিত জগতের সবাই তো প্রথম শ্রেণীর, তারা কেউ এলে এদিকে উঁকি দেবে না।
ছেলেটা কাঁদছে।
স্টেশন থেকে কিছু কি খাওয়াবে ওকে?
কী খাওয়াবে?
একমাত্র খাওয়ানো চলে ফল। লেবু কলা। কিনল, খাওয়াতে চেষ্টা করল একটু। কিছু বা খেল, কিছু খেল না। সুমনার মনে হল, এতটা অবিমৃষ্যকারিতা না করলেই হত! অন্তত অচিনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল।
খাওয়ার, পরার।
কিন্তু সে জিনিসগুলো কি একটা আধটা?
ফুড স্টোভ স্পিরিট দেশলাই, সসপ্যান বাটি চামচ, ফিডিং বটল, সেগুলো সাফ করবার জন্যে ব্রাশ সাবান। তা ছাড়া স্নানের প্রসাধনের তোয়ালে তেল সাবান চিরুনি, পাউডার কাজল, জামা জুতো মোজা, কাঁথা বালিশ–আরও কত কত!
অবশ হয়ে এল সমস্ত শরীর।
সুমনার ঘরটা ভর্তি যা কিছু যত কিছু সবই তো ওর দরকারি। প্রত্যেকটি মুহূর্তে দরকার।
সেই জিনিসের বোঝা কীসে নিত সুমনা? মস্ত একটা সুটকেসে? সেটা কে বইত? মুটে? মোটঘাট আর ছেলে নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠলে বেশ শোভন হত, সুন্দর হত!
কে সসম্মানে দরজা খুলে দিয়ে বলত, এসো এসো!
নাঃ ঘরে বাইরে কোথাও সম্মানের আশা নেই, এই নাম-গোত্রহীন ছেলেটাকে নিয়ে। তবু তো হতভাগা ছেলেটার জন্যে ভেবে আকুল হচ্ছে সুমনা। ভাবছে, কতক্ষণ খায়নি, কতক্ষণ ভাল করে শোয়নি।
কোলের ভিতর কতক্ষণ থাকতে পারে–দুষ্ট দুরন্ত ছেলে? কতক্ষণ ভাল লাগে?
আচ্ছা, সুমনা যে চলে এল, পালিয়ে এল, তাকে কেউ খুঁজে বেড়াচ্ছে না? বেড়াচ্ছে অবশ্যই। অলক, সিদ্ধার্থ, বাবা!
সিদ্ধার্থ অপদস্থ হবে।
সেই আশ্রমের কর্তৃপক্ষের কাছে।
সিদ্ধার্থ জীবনে আর কখনও ক্ষমা করবে না সুমনাকে।
কিন্তু সুমনাও তো আর কারও ক্ষমা চায় না, ভালবাসা চায় না, প্রতি প্রেম স্নেহ সহানুভূতি কিচ্ছু চায় না। সুমনা শুধু একটা জেদের অহংকার নিয়ে পৃথিবীটা দেখতে চায়। আর পৃথিবীকে দেখাতে চায়।
এতক্ষণ এত আলোড়নেও যা হয়নি, তাই হল। হঠাৎ একঝলক জল এসে চোখ উপচে গাল ভাসিয়ে দিল।
.
অ মেয়ে, যাবে কোথায়?
একটি নিতান্তই গাঁইয়া বুড়ি প্রশ্ন করে, কোথায় যাবে?
সুমনা ইচ্ছে করলেই উত্তর না দিয়ে থাকতে পারে। মুখ ঘুরিয়ে বসতে পারে। কিন্তু তা পারতে দেয় না তার শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতা।
চোখের জল মুছতে গেলে বেশি প্রকাশ।
তাই মুখ ফিরিয়ে ধরা গলায় বলে,শ্রীরামপুর।
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে স্থান নির্বাচন করে ফেলেছে সুমনা। শ্রীরামপুরেই যাবে। সেখানে দীপা আছে। অসামান্য নয়, সামান্য বন্ধু। তবু এই ভয়ংকর মুহূর্তে তার নামটাই মুখে এসে গেল।