আর সত্যি, সকলের কাছেই তো রেখে ঢেকে কথা বলতে হয়, স্বামীর কাছেও যদি মনের কথা খুলে না বলতে পারে, বাঁচবে কী করে?
আসলে শাশুড়ি জায়েদের অপছন্দ ভাবটাই সুজাতার জেদকে উসকে দিয়েছিল। কেন যাবে না সে? যাবার জন্যে উপযুক্ত একটা কারণ যখন উপস্থিত হয়েছে। স্বামীর এত রোজগার, ইচ্ছে করলে কত কীই তো করতে পারে সুজাতা। কিন্তু কে কী ভাববে ভেবে করতে পারে না।
এবার মনের জোর করে এসেছিল।
কিন্তু ভগবান এমন বাদী যে, সেই কে কী ভাবারই মস্ত একটা কারণ নিয়ে ফিরতে হচ্ছে তাকে।
এই যদি শুধু স্বাস্থ্যে টলমল মেয়েকে নিয়ে ফিরতে পারত সে, সবাইকে তো বড় মুখ করে দেখাতে পারত! বলতে পারত, পাঁচজনের মুখ না চেয়ে, জোর করে চলে গেলাম বলেই না এইটি হল।
এই একমাসেই তো যথেষ্ট কাজ হয়েছিল। সেরে উঠেছিল সুমনা। মুখের সেই পাণ্ডুর ভাব, শরীরের সেই ক্লান্ত ঢিলে ভাব, সব দূর হয়ে গিয়েছিল। ইদানীং কতখানি করে হাঁটতে পারছিল।
হাঁটতে পারছিল!
অনেকখানি করেই পারছিল।
ভাবতে গিয়ে থমকে গেল সুজাতা।
যেন হোঁচট খেল।
অতটা না পারলেই বুঝি ভাল ছিল। যদি না পারত, তা হলে তো চলে যেত না না সেই সাঁওতাল বস্তি ছাড়িয়ে জঙ্গলের ধারে।
অবাক হয়ে যাচ্ছে সুজাতা, কদিন ধরেই ভাবছে আর অবাক হচ্ছে, সুজাতার ভাগ্যেই ঠিক সেই সময়, ঠিক সুমনার চলার পথের ধারে, পড়ে থাকতে হয় সুজাতার শাস্তির শনি?
একদিনই তো মাত্র অতটা হেঁটে গিয়েছিল সুমনা।
সুজাতা কেন একা ছেড়েছিল মেয়েকে?
ভাবল সুজাতা। মনের কপালে করাঘাত করল। সুজাতা যদি সঙ্গে থাকত, তা হলে কি সুমনা এই অঘটনটা ঘটিয়ে তুলতে পারত? পারত না, ছুঁতেই দিত না সুজাতা।
এখানেও একবার হোঁচট খেতে হল সুজাতাকে। দিত না! সে জোর কি আছে সুজাতার? ছোট থেকে কখনও পেরেছে মেয়ের কোনও খেয়ালকে নিবৃত্ত করতে? সেই কোন ছোটবেলা থেকে পথের জিনিস কুড়িয়ে কুড়িয়ে ঘরে এনে তোলেনি সুমনা!
মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো রাস্তার কুকুরছানা নিয়ে এসেছে তিন-তিনবার। যখন-তখন কোথা থেকে না কোথা থেকে এনেছে কুচি কুচি বেড়ালছানা।
সবাই ঘিন ঘিন করেছে, ছি ছি করেছে, সুজাতা পর্যন্ত ছাড়েনি দুর দুর করতে, কিন্তু সুমনাকে টলাতে পারা যায়নি। তাদের বুকে করে বসে থেকেছে, নিজের দুধ থেকে দুধ খাইয়েছে, নিজের জামা ফ্রক পেতে শুইয়েছে। তাদের মানুষ করে তুলতে জীবন পণ করেছে।
আজও রাস্তার জিনিস কুড়িয়ে এনে ঘরে তুলেছে সুমনা। শুধু এটা কুকুর বেড়ালের ছানা নয়, মানুষ ছানা। কিন্তু কুকুর বেড়ালের চাইতে কি উচ্চ পদ দেবে কেউ তাকে? মানুষ বলে গণ্য করবে?
সুজাতা নিজেই কি তা করছে?
করছে না।
সুজাতা সবসময় সিটিয়ে আছে। আর ভাবছে, ওই জঙ্গলের ধারে, শেয়াল কুকুরের মুখ থেকে রক্ষা পেল কী করে জীবটা? নিদেনপক্ষে সাঁওতালিরাও তো নিয়ে যেতে পারত।
তা নয়, সুজাতার সংসারের শান্তি নষ্ট করতে সমস্ত কিছুর চোখ এড়িয়ে বেঁচে রইল হতভাগাটা।
রাক্ষস! রাহু! শনি!
কুকুর বেড়ালের মতোই ঘৃণ্য, অথচ তাদের মতো সমস্যাহীন নয়।
ডাস্টবিনের কুকুরকেও কেউ অপবিত্র বলে না। তাদের জন্মের শুচিতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সাবান দিয়ে ধুয়ে তুলে নিয়েই বিছানায় বসায়, কোলে বসায়।
হঠাৎ স্বামীর ওপর রাগে সর্বশরীর জ্বালা করে উঠল সুজাতার। হাতের কাজ ফেলে বসে পড়ল সে। উনি, ওই উনিই এর কারণ। ছোটবেলায় যখন মেয়ে পথ থেকে কুকুর বেড়ালের ছানা কুড়িয়ে এনেছে, বাড়ির সবাই মারমুখী হয়ে দুর দুর করেছে, কান্তিকুমারই মেয়েকে আহ্লাদ দিয়ে বলেছেন,আহা থাক না! কচি মনের মায়াটাকে অমন করে মরিয়ে দিও না।
এখন?
এখন নিজেই কেন অমন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন কান্তিকুমার? কই, মেয়ের কোমল মায়াটুকুকে তো আদর করে আহা বলতে পারছেন না? গুম হয়ে গেছেন কেন?
সুজাতা ভাবল, জীবনে মানুষ বহু যন্ত্রণা সহ্য করে নেয়। অনিবার্য বলেই নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু যা অনিবার্য নয়, সম্পূর্ণ উড়ো আপদ, তাকে মেনে নেওয়া যায় কী করে? মন যে বিদ্রোহী হয়েই থাকে। না না, সুমনার খেয়ালে সৃষ্ট এই বিপদের যন্ত্রণা সহ্য করে নেওয়া হবে না।
উঃ, সেদিনটাকে যদি স্লেটের লেখার মতো হাত দিয়ে মুছে দিতে পারত সুজাতা।
সেই ক্রুর কুটিল দিনটাকে।
অথচ সেদিনটা তার দুমিনিট আগে পর্যন্তও ভারী মনোরম একটি চেহারা নিয়েই প্রকাশিত ছিল। বড় সংসারের অন্তরালে বড় রোজগেরে স্বামীকে তো চক্ষে দেখতেই পায় না সুজাতা। অথচ কোন ফাঁকে যে বেড়ে গেল বয়েস, চল্লিশে পা ফেলল!
পুজোয় কোর্ট অনেকদিন করে বন্ধ থাকে, অনেকদিন ধরেই তো বেড়িয়ে বেড়াতে পারে সুজাতা নিজের ছেলেমেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে। কিন্তু তা হয় না। বাড়ির আরও অনেক সমস্যাকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে, অনেক সমারোহ করে হয়তো বারোটা পনেরোটা দিন বেড়িয়ে আসেন কান্তিকুমার। পনেরো দিনেই টাকার ঘন্ট হয়ে যায়।
হয়তো বা এমনও হয়, সুজাতাই সে যাত্রায় নেই। সংসারে অসুবিধে, মায়ের শরীর খারাপ, ছোটবউ বাপের বাড়ি, এসব নানা প্রতিবন্ধকে বড়রা থেকে গেল, কান্তিকুমার ছেলেমেয়ে ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নে ভাগ্নীর একটি শোভাযাত্রা করে বেড়াতে গেলেন।
বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে সুমনাই বড়।