ধরে রেখেছে একটা স্কুলের মেয়েকে।
শুকনো মুখ, শ্রীহীন শাড়ি, ছেঁড়া চটি। অপরাধের মধ্যে তার চোখে চশমা।…সঙ্গে বাচ্চা নেই। তা না থাক–চশমাটা তো রয়েছে।
তাঁতির মাকুর মতো কলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত টানাপোড়েন করে বেড়ান কান্তিবাবু, অলক, সিদ্ধার্থ।
আর বেলা যখন পাঁচটা, তখন টেলিফোন বেজে ওঠে কান্তিকুমারের ঘরে, থানা থেকে নয় রেলওয়ে স্টেশন থেকে। মেয়ে গলা।
না, সে বলবেনা কোথা থেকে বলছে। হাওড়া কি শেয়ালদা। শুধু জানাচ্ছে…তাকে যেন আর খোঁজা হয়, সে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
.
সুজাতা তীব্র তিরস্কারে বিঁধে রেখে চলে গিয়েছিল।
সুজাতা ভাবেনি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সুমনা। যেতে পারবে।
ছেলে কোলে করে যাবে কোথায়!
তাই নিজের ঘরে গিয়ে খাটের বাজুতে মাথা ঠুকছিল আর ভাবছিল আরও তীব্র কিছু বলতে পারলে ভাল হত। আরও কঠিন আরও মর্মান্তিক। যাতে রাগে-অপমানে ছটফটিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে সুমনা।
ছেলেটাকে একবার চোখ ছাড়া করে রেখে এলেই যে সুমনার ঘাড়ের ভূত নামবে, এ বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই সুজাতার। নিজের হাত যদি থাকত সুজাতার, কবে মেয়েকে ওই ভূতের হাত থেকে উদ্ধার করত। কিন্তু সুজাতার নিজের হাতে কিছুই নেই। হাত না থাকলেই সব বিষ জিভে উঠে আসে। এই নিয়ম। তাই সুজাতা ভাবছিল আরও বিষ ছড়িয়ে আসতে পারলে হয়তো কাজ হত।
ভাবেনি, কাজ হচ্ছে তখন অন্য পথে।
.
মা চলে যাবার পর সুমনা ড্রয়ার খুলল। গুনে টুনে দেখল না। সে ধৈর্য নেই এখন। যত যা টাকা পয়সা ছিল, মুঠো করে তুলে নিয়ে বটুয়ায় ভরল। পোস্ট অফিসের পাশবইটা নিল।
আগে মাঝে মাঝেই আদর করে টাকা দিয়েছে সবাই, বই কিনতে শাড়ি কিনতে। সব ফুরোয়নি। সুজাতাই জোর করে জমা দিইয়ে দিয়েছিল, সুমনার ঘোরতর আপত্তি অগ্রাহ্য করে।
জীবনে এই প্রথম মায়ের বুদ্ধিটা সত্যিকার বুদ্ধি বলে মনে হল সুমনার।
টাকা নিল, গয়না নিল না।
গলার হারটা আর হাতের বালা দুটো খুলে ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ারের চাবিটা রেখে দিল ড্রয়ারের ওপর। তারপর ছেলেটাকে তুলে কাঁধে ফেলল।
সিঁড়ি দিয়ে নামা চলবে না।
সবাই দেখতে পাবে।
বাথরুমের দিকে জমাদার ওঠবার লোহার সিঁড়িটার দিকে তাকাল। ওই ওইটাই এখন ভরসা।
নেমে গেল ঘুরে ঘুরে।
দেখতে পাবে না। কেউ এদিকে আসে না।
যদি দেখতে পায়?
বলবে, বেশ করেছি চলে যাচ্ছি। আমাকে আটকাতে পারো না তোমরা। আমি নাবালিকা নই।
অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেন ঝগড়া করে সুমনা।
দামাল হয়ে ওঠা ভারী ছেলেটাকে কাঁধে ফেলে রাখা সহজ নয়। অনবরত তাকে চেপে ধরতে হচ্ছে। তবু দ্রুত পায়ে বাড়ির পিছনের গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়ে সুমনা। কিন্তু আশ্চর্য, একটা চেনা মুখের সামনে পড়ে না।
কলকাতা শহর এমনিই।
পাড়ার লোকও তাকিয়ে দেখে না।
অথবা দেখলেও কিছু বলে না।
সামনের নীল বাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছিল নীল বাড়ির একটা মেয়ে। মাকে গিয়ে বলল, কান্তিবাবুর বড় মেয়ে সেই ছেলেটাকে কোলে নিয়ে কোথায় বেরোল।
মা বলল, একলা?
তাই তো দেখলাম।
তা হলে ডাক্তারের কাছেটাছে গেল বোধহয়। শুনেছি তো বাড়ির লোকের সঙ্গে নন কো-অপারেশন! লজ্জাও করল না ঘাড়ে করে রাস্তায় বেরোতে?
ও দিকের হলদে বাড়ির বারান্দা থেকে দেখলেন হলদে বাড়ির গিন্নি। মেয়েকে ডেকে বললেন, দেখ, দেখ কান্তি উকিলের মেয়েটা সেই ছেলেটাকে ঘাড়ে করে একটা ট্যাক্সিতে উঠছে। কোথায় যাচ্ছে বল দিকি?
মেয়ে সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে, অনাথ আশ্রমে।
অনাথ আশ্রমে?
হ্যাঁ। এইবার তো বলেছে দিয়ে দেবে।
কে বললে তোকে?
ওর খুড়ি ছোটপিসির চেনা নয়?
এটা একটা উত্তর নয়, তবু উত্তর বলে মেনে নিল মা।
দেখল পাড়ার কটা ছোট ছেলে।
যারা রাস্তার মাঝখানে ইট খাড়া করে ক্রিকেট খেলছিল। দেখল এ বাড়ি ও বাড়ির কটা চাকর, যারা একটা বাড়ির রোয়াকে বসে গুলতানি করছিল। ওরা শুধু দেখল, কোনও মন্তব্য করল না।
কিন্তু সুমনার বাড়ির কেউ দেখতে পেল না। সুমনা নির্বিবাদে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল।
আপাতত লোকের চোখ থেকে তো রক্ষা পাওয়া যাক, তারপর ভাবছি, অতঃপর কী করব! ভাবল সুমনা।
.
প্রফেসর আর কের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে?
বলবে, আপনার নির্দেশ মানতে পারলাম না। হেরে গেলাম। এখন বলুন এর পর কী করব।
না। তা হয় না।
প্রফেসর যখন বলবেন,আমি তোমায় ইনটেলিজেন্ট বলেই জানতাম সুমনা
.
কোথায় যাবেন?
ড্রাইভার জানতে চাইছে।
ঠিক যে কথাটা সুমনা নিজেই নিজের কাছে জানতে চাইছিল এতক্ষণ।
বলল, শেয়ালদা স্টেশন।
শেয়ালদা কেন বলল?
গন্তব্যস্থান কি তবে নির্বাচন করা ছিল সুমনার?
না, তা নয়।
ওর হঠাৎ মনে হল হাওড়ায় অনেক ভিড়, হয়তো অনেক চেনা মুখ বেরোবে। শেয়ালদা একটু লুকোনো, একটু চাপা, একটু নিশ্চিন্তের।
স্টেশনে নেমে কী করবে? তা জানে না সুমনা।
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই বুঝি সন্ধ্যা হয়।
গাড়ি থেকে নামবার আগেই দেখল কাকিমার ভাই আর ভাজ। ওঃ রানাঘাটে যাচ্ছেন ওঁরা। যেটা কাকিমার বাপের বাড়ি। গতকাল যেন ওঁরা এসেছিলেন না সুমনাদের বাড়িতে? কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে? অবশ্যই সবই জেনে গেছেন, শুনে গেছেন।
ওঁদের সামনে নামা চলবে না।
ব্যাকুল হয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশে নিবেদন জানাল, দেখুন, শুনছেন? আমার বলতে ভুল হয়েছিল, শেয়ালদা নয়, হাওড়া।