তোমার কষ্ট হবে?
তুমি সারাজীবন নিশ্বাস ফেলবে? তাতে কী! আমাদের আওতা ছাড়িয়ে আমাদের বাদ দিয়ে তোমার যে সুখ, সে সুখে সহানুভূতি নেই আমাদের।
এই তো!
এই রকমই তো।
এর ওপর আবার সিদ্ধার্থ আলাদা বাসা করে নব-বিবাহিতাকে নিয়ে সংসার পাততে চায়। এর পরেও ক্ষমা করা হবে!
কথায় কথায় ওদেশ দেখাই বলে, আর ওদেশের ফ্যাশানগুলো রপ্ত করে নিয়েছি বলে, সত্যি তো আর ওদেশি হয়ে যাইনি আমরা।
একটা সন্দেহযুক্ত মেয়েকে বিয়ে করা গর্হিত।
বিয়ে করেই আলাদা হওয়াটাই গর্হিত।
মা বাপের সঙ্গে চোটপাট করা তো আরও গর্হিত! তিন-তিনটে গর্হিত কাজ করেও পরিত্যক্ত হবে না সিদ্ধার্থ?
সিদ্ধার্থকে তবে খুঁজতে যেতে হবে তার নতুন বাসায়। সে বাসা অলক আগে দেখে এসেছে।
তবু বুদ্ধি করে সেই শিশু প্রতিষ্ঠানে ফোনে খোঁজ করল।
ওখানে কি উপস্থিত আছেন উনি? সিদ্ধার্থ মজুমদার! আজ একটি বেবিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল যাঁর?
একটু পরেই যাবার কথা!
না।
যায়নি।
অতএব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে গেল সেই নতুন বাসায়।
আর অবাক হয়ে দেখল চারদিকের ঝড় উপেক্ষা করে ঘর সাজাচ্ছে সিদ্ধার্থ।
এটা কী হচ্ছে?
টবে গাছ প্রতিষ্ঠা।
ওদিকে সংসার প্রতিষ্ঠা তো মাথায় উঠল।
কেন? মানে?
সুমি এখন বলছে, ছেলে ছাড়বে না!
ছেলে ছাড়বে না!
সিদ্ধার্থ হাসল।
বলল, বলবে জানতাম।
বলবে জানতে?
হ্যাঁ অলক!
সিদ্ধার্থ একটু রহস্যময় হাসি হাসে, জানতাম। কারণ সুমনাকে যে জানি। তাই তো বাড়ির লোককে একটা মিথ্যে কথা বলে চটিয়ে এলাম।
মিথ্যে কথা।
হ্যাঁ, হিসেবমতো মিথ্যেই! তবে জানো তো কোনও মিথ্যেকে যদি বারবার সত্যি বলে ঘোষণা করা যায়, সেটা আর মিথ্যে থাকে না, সত্যি হয়ে ওঠে।
তুমি যে রহস্যময় হয়ে উঠেছ সিদ্ধার্থ! বাড়ির লোককে চটিয়েছ সেটা বুঝে এলাম।
গিয়েছিলি বুঝি?
হ্যাঁ। তোমার দাদা বললেন তোমার এই চন্দ্রবদন যত না দেখতে হয় তাঁদের ততই মঙ্গল! ব্যাপার কী?
বাপার বলতে কিছু না। ওই ছোট্ট একটু অনৃতভাষণ! ভেবে দেখলাম, সুমনা যখন ছেলেটাকে ছাড়বেই না, তখন ওটাকে দুজনে ভাগ করে নিলেই ওর ভার কমে। ছেলেটাকে নিজেরই কুকীর্তির ফল বলে চালিয়ে দিলাম আর কি
সিদ্ধার্থ!
আহা হা চমকাচ্ছিস কেন বাবা? তোর বোনের তো আর তাতে জাত যাচ্ছে না। কান্তিকাকা ডেকে ধমকালেন। বললেন, আমার কুমারী মেয়ের নামে দুর্নাম রটাচ্ছ কোন সাহসে! দিলাম একটু শুনিয়ে। বললাম, দুর্নাম তো আপনারাই রটিয়ে বেড়িয়েছেন। বেচারা ভদ্রলোককে শুনিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তখন টাটকা বাড়ি থেকে ঝগড়া করে এসেছি। কিন্তু তুই অমন বজ্রাহত বনস্পতি মেরে গেলি কেন? বুদ্ধিটা কিছু খারাপ হয়েছে?
কিন্তু এ তুমি কী করলে সিদ্ধার্থ?
ঠিকই করলাম অলক! চল এখন সেই বিদ্রোহিণীকে জানিয়ে আসি, তোমার পোষা বৎসটিকে আর বিদায় দিতে হবে না। তাকে মজুমদার শাবক নামে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা হবে।
স্বপ্নহতের মতোই বাড়ি ফেরে অলক।
ভাবতে পারে না, এ সিদ্ধার্থের উদারতা, না নির্বুদ্ধিতা!
কিন্তু নির্বুদ্ধিতা কি একা সিদ্ধার্থেরই?
কতবড় নির্বোধ সুমনা!
.
সুমি! সুমি!
সুজাতা এসে আছড়ে পড়ল, সুমিকে তা হলে তোরা নিয়ে যাসনি? আর আছড়ে না পড়ুক ভিড় করল বাড়ির সবাই।
না তো। ও তো যাবে না বলে জেদ ধরে
তাই তো জানি অলক, হঠাৎ দেখছি নেই। জানি না কোথায় চলে গেল, আর কী করে চলে গেল। কেউ তো দেখতেও পায়নি। ঘরভরা জিনিস, সব পড়ে বাবা! সিদ্ধার্থের দিকে তাকায় সুজাতা,ছেলেটা বাড়ি থেকে চলে যাবে বলে, পাঁচজনে দিয়েছিল আদর করে খেলনা পুতুল জামা জুতো। সব ফেলে রেখে শুধু ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় পালিয়ে গেল।
সিদ্ধার্থ শুকনো মুখে বলে, এমনি কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে যায়নি তো
কোথাও যায় না বাবা! এই ঘরটার ভিতর পড়ে থাকে। কী খেয়াল হল নিজেই বলল, কোথায় আশ্রমে ভর্তি করে দেবে, নিজে কলেজে ভর্তি হয়েছে–আজ হঠাৎ কী মতি হল, বলল, যাব না। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাব! কিন্তু সত্যি চলে যাবে, ভাবিনি।
কেঁদে ফেলল সুজাতা।
কিন্তু পুরুষদের তো আর কাঁদা চলে না।
তাই তাঁদের ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে যেতে হয়, কোথায় পালাল খেপে যাওয়া মেয়েটা, তাই খুঁজতে।
হ্যাঁ, বাপ কাকা জেঠা দাদা প্রেমিক, সবাই ছোটাছুটি করছে।…ব্যাপারটার গুরুত্ব আর অস্বীকার করা যায় না।
থানায় থানায় খবর চলে যায় একটি শিশু-সমেত একটি তরুণী মেয়ে নিখোঁজ। বুদ্ধি ঈষৎ অপ্রকৃতিস্থ। মেয়েটি লম্বা ফরসা…চশমা চোখে…বাচ্চাটি গৌরাঙ্গ স্বাস্থ্যবান।
কিন্তু আশ্চর্য, এত তাড়াতাড়ি এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সুমনা!
সন্দেহ নেই বাড়ি থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি চেপেছে। কিন্তু কোন্ দিক লক্ষ্য করে?
.
তা হয়রানি হয় বইকী!
সকলেরই হয়।
আরও হয়রানি হয় থানার কার্যতৎপরতায়। বাচ্চা সমেত মেয়েছেলে এক-একটা ধরে ফেলেছে প্রায় সকলেই।
তাই শনাক্ত করতে ছুটতে হয় মুচিপাড়া থানায়, তালতলা থানায়, বড়বাজার থানায়।
একটা আধবয়সী ঝি মনিবের ছেলে কোলে রাস্তা পার হতে বিভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, তার সেই বিভ্রান্তির সুযোগ তৎপর পুলিশ ছাড়েনি।
একটা বাজারের শাকওয়ালী দিনের শেষে খালি ডালা আর ভর্তি গেঁজে নিয়ে ফিরছিল, সঙ্গে একটা বছর আষ্টেকের ছেলে, তাদের আটকে রেখে চৌদ্দপুরুষান্ত গালাগালি খাচ্ছে পুলিশ।