বুদ্ধিমান পৃথিবীর সমস্ত বিবেচনা দাঁড়িপাল্লার একদিকে, আর একদিকে শুধু সুমনার ব্যাকুল ভালবাসাটুকু…অবুঝ হৃদয়খানি।
সুমনা জিতবে কীসের জোরে?
সবাই যখন চলে গেছে, শুয়ে গেছে, রাত্রি গম্ভীর হয়ে গেছে, ঘুমন্ত শিশুটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে বসে আছে সুমনা।
কাল থেকে সুমনার বিছানার পাশের এই জায়গাটুকু শূন্য পড়ে থাকবে।…অবোধ শিশুটা জানে না কী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সুমনা তার বিরুদ্ধে। একান্ত নির্ভরতায় নিশ্চিন্ত সুখে এলিয়ে শুয়ে আছে ভয়ংকর সেই বিশ্বাসহন্ত্রীর বুকের কাছে।
ওরে সোনা, ওরে মানিক! ওরে পাগলঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত শিশুটাকে বুকের মধ্যে চেপে পিষে ফেলতে চায় সুমনা।
ছাড়বে না। কিছুতেই ছাড়বে না সে।
কিছু চাই না তার। কিছু না।
চাই না উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ…সুখময় দাম্পত্য জীবন…সামাজিক প্রতিষ্ঠা। এই চরম পাপের মূল্যে সেই পরম প্রাপ্তিকে কিনতে চায় না সুমনা। সুমনা ওকে এমনি করে আঁকড়ে ধরে থাকবে। জগতের কে পারে ছিনিয়ে নিতে দেখবে সে!
কান্তিকুমার সিদ্ধার্থকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
এসে দাঁড়াতেই একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কান্তিকুমার রুদ্ধস্বরে বলেন,তোমার বাবা এসে আমায় যাচ্ছেতাই করে গেলেন।
কেন গেলেন, বুঝতে দেরি হয় না সিদ্ধার্থের, তবু মাথা চুলকে বলে,আজ্ঞে—
কেন, তা তুমি অবশ্যই বুঝতে পারছ। আশ্চর্য! আমার কুমারী মেয়ের নামে অকারণ এই অপবাদ দেবার কী উদ্দেশ্য তোমার? আমি তো কোনওদিন এতটা নীচ ভাবিনি তোমাকে।
কুমারী মেয়ে!
সিদ্ধার্থ কুণ্ঠিত ভাবটা পরিহার করে বলে, আপনার কুমারী মেয়ের নামে অপবাদ যা রটাবার তা আপনার নিজের বাড়ি থেকে রটানো হয়েছে। আমি শুধু সেই অপবাদের কদর্যতাকে একটু মোলায়েম আচ্ছাদন দিয়ে ঢাকতে চেয়েছি। আর ওইটুকু না করলে আমার বাড়িতে সংঘর্ষ উঠত প্রবল। তার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হতে অনেক শক্তি ক্ষয় হত। বৃথা শক্তিক্ষয়ে দরকার কী?…আপনি তো উকিল মানুষ, আপনাদের নীতিতে তো ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক কার্যোদ্ধার!
নীতিকথা থাক। আমি বলছি, তোমার এই পদ্ধতিকে সমর্থন করি না।
কান্তিকুমার জোরের সঙ্গে বলেন।
সিদ্ধার্থ মুখ নিচু করে বলে, এ ছাড়া উপায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। এলগিন রোডের কাছাকাছি একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট নিয়েছি, হয়তো অতটুকুর মধ্যে ওর কষ্ট হবে, তবু আমার বিশ্বাস, ও পারবে।
কিন্তু এই মিথ্যা অপবাদটা কি অপরিহার্য ছিল?
হয়তো ছিল না। হয়তো ছিল। অপবাদটা যে এসেইছিল। আমার পরিবার আমার স্ত্রীকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখবে, ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে, এ আমি সইতে পারছিলাম না, তাই অপবাদটা ভাগ করে নিলাম। আপনি আমার ওপর অপ্রসন্ন হবেন না কাকাবাবু, আমি বলছি এ ভালই হল।
.
অলক গাড়ি বার করে রেখে এসে মাথায় হাত দিয়ে পড়ল।
সুমনা যাবে না।
সুমনা ছেলেটাকে দুহাতে বুকে চেপে ধরে খাঁচার বাঘের মতো ঘরের মধ্যে পদচারণা করে বেড়াচ্ছে।
ব্যাপার কী?
অলক অবাক হয়ে বলে।
সুমনা নীরব।
শুধু পদচারণায় অস্থিরতা বেড়ে ওঠে।
মনা! কী হল? টাইম দেওয়া আছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
ও যাবে না।
দৃপ্তম্বর ঠিকরে ওঠে।
যাবে না।
অলকের বিস্ময়ের পালা।
এত ব্যবস্থা, এত বলা কওয়া, টাকাপত্র জমা দেওয়া! এখন বলছিস যাবে না?
হ্যাঁ বলছি।
সুমি, তুই কি পাগল হলি?
সুমনা ঘরের কোণের দিকে চলে যায়। ক্রুদ্ধস্বরে বলে, হ্যাঁ হয়েছি। কী করবি?
আমি আর কী করব? আমি তো হাঁ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সিদ্ধার্থটা সেইখানে বসে থাকবে।
বসে থাকবে?
হ্যাঁ সেইরকমই তো কথা আছে। সিদ্ধার্থ বসে থাকবে, আর আমি তোদের নিয়ে।
না! কোনও কথা নেই। তোদের কোনও কথা থাকবে না। তোর কথা, তোর সিদ্ধার্থের কথা সব উড়িয়ে দেব আমি। আমি একে নিয়ে চলে যাব।
চলে যাবি! কী সর্বনাশ! কোথায় চলে যাবি?
যেখানে খুশি। শুধু তোদর এই বাড়ির মধ্যে থেকে। বনে জঙ্গলে যেখানে হোক চলে যাব।
মনা! মাথাখারাপ করিস না। এত ভেবেচিন্তে একটা ব্যবস্থা করা হল, তুই রাজিও হলি, এখন উলটো-পালটা করলে চলবে কেন?
চলবে! আমি চালাব।
সিদ্ধার্থ বলবে কী?
জানি না। যা ইচ্ছে বলুকগে।
জানিস, ও ওর বাড়িতে মনোমালিন্য করে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছে। বিয়ে করবে বলে সাজিয়েছে! এখন তুই ।
দাদা তুই যা! যা এখান থেকে।
তুই যাবি না?
না।
বেশ। যাই সেখানে। খবর দিই গে। ওই কথাই বলি গে। বেশ বুঝতে পারছি মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে তোর।
অলকের একা বেরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
অলক খবর দিতে যাচ্ছে, সুমনা যাবে না।
সুমনা ছেলেকে ছাড়বে না!
গত কদিনের অনুতাপদগ্ধ মনোভাব মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আশাভঙ্গের আক্রোশে আবার হিংস্র হয়ে ওঠে ওরা।
এও হয়। এই রকমই হয়।
গুডবাইয়ের পর আবার যদি কেউ থেকে যাবার বায়না করে, শুকিয়ে যায় সকলের সব স্নেহধারা।
যোগমায়া সুজাতার কাছে এসে দাঁড়ান, মেজোবউমা, এটা কী হল?
সুজাতার মন ভেঙে গেছে।
মন কেমন একটু করছিল সত্যি, কিন্তু মস্ত একটা আশাও সৃষ্টি হচ্ছিল বইকী!
কালো ছায়াটা সরে যাবে। যে ছায়া গ্রাস করে রেখেছে সুমনাকে।
ভেবেছিল, সুমনা প্রথমটা অবশ্যি মনমরা হয়ে থাকবে, কিন্তু কলেজ যাবে, পড়াশোনা করবে, ভুলে যাবে। বলে সত্যিকার ছেলে মরে গেলে তার মৃত্যুশোক ভুলে মা আবার খাচ্ছে পরছে হাসছে। আর এ তো!