কিন্তু বলতে পারলেন না।
কেন পারলেন না সেইটাই আশ্চর্য!
শেষ পর্যন্ত যে সেই এক থোকা ফুলের মতো ছোট্ট শিশুটার জায়গা হল না তাঁর বাড়িতে, তাকে বিদায় করে দিতে হল, এই লজ্জাটাই হয়তো মূক করে রাখল তাঁকে।
হয়তো এমনিই হয়।
যাকে দুরছাই করি, আপদ বালাই করি, সে যদি একদিন স্বেচ্ছায় বিদায় গ্রহণ করে, যদি বলে, তবে গেলাম, তখনই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। উঠতে বসতে যার কথায় বলি, মরেও না–সে যখন মরে তখন মনে হয়, একটা চাবুক খেলাম বুঝি।
এমন চাবুক থাকেই মানুষের জন্যে।
সুমনা যখন বলল, তোমাদের খুশি করবার মতো খবর, তখন কি কান্তিকুমার ধারণা করতে পেরেছিলেন এতবড় একটা চাবুক আসছে তাঁর জন্যে?
চাবুক-খাওয়া মানুষ আর বেশি কী বলবে?
কান্তিকুমারেরও আর সাধ্য হল না বেশি কথা বলবার।
কিন্তু বাড়ির মধ্যে কথার ঢেউ উঠল।
কে যে প্রথম বলল! কী করে যে রাষ্ট্র হল, এই এক রহস্য। সুমনা তো বাবাকে ছাড়া আর কাউকে বলেনি। আর কান্তিকুমারও বলতে যাননি কাউকে। তবু প্রকাশ হয়ে গেল।
হয়তো অসাবধানী অলকের কথার মধ্যে থেকেই আবিষ্কৃত হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ উঠল। সে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল বালুবেলায়।
বটে, বটে, তাই নাকি?…সত্যি? তা হলে সুমতি হল?..ঘাড়ের ভূত নামল তবে এতদিনে?
আরে বাবা, বুঝছ না, গ্রহে করেছিল, কুগ্রহে…হ্যাঁ তবু দুর্মতি কেটেছে তাও ভাল। তবে কিনা সেই তো মান খসালি, লোকটাই যা হাসালি!
এইরকম চলতে লাগল প্রথমদিকে।
তারপর বাতাসটা ঈষৎ অন্যমুখো বইতে শুরু করল।
…দেখ মানুষের মন! ছেলেটাকে নিয়েই সংসারে যত অশান্তি, অথচ চলে যাবে শুনে পর্যন্ত…আহা যতই হোক কচি ছেলে তো! নইলে চোখেই দেখছি না, কোলেও নিচ্ছি না, তবু
অতঃপর বাতাস আরও মস্ত এক মোড় নিল।
ছোটখুড়ি বললেন, মনে করেছিলাম ছেলেটাকে একটা সোয়েটার বুনে দেব, লাল পশম খানিকটা রেখেওছিলাম, কিন্তু সুমনার ভয়ে সাহস হয়নি। চলে যাবে শুনে মনটা এত ইয়ে হচ্ছে! ছোট বাচ্চার নাম করা জিনিস
দুদিনের মধ্যে একটা হাতকাটা সসায়েটার বুনে ফেলে সুমনার ঘরে রেখে গেলেন তিনি।
আর সেই সোয়েটারের কাটা খাল বেয়েই আসতে লাগল কাঠের পুতুল, তুলোর হাতি, প্লাস্টিকের ভালুক, রবারের বল…এটা ওটা সেটা।
দাতা-ঠাকুমা, জেঠিমা, পিসিমা, মায় ছোটকাকা এবং বুড়ো ঝিটা পর্যন্ত।
সকলেরই নাকি ছেলেটাকে কিছু দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, শুধু সুমনার মেজাজের ভয়েই
এখন আর কেউ ভয় পাচ্ছে না।
এখন সুমনার ছেলের জিনিসে সুমনার ঘর ভরে যাচ্ছে।
আর আক্ষেপের বুলিতে বাড়িতে বাতাস ম ম করছে।
আহা সেই অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়াই হল, শুধু জেদ করে কতকগুলো মাস বাড়িতে রেখে রেখে বাড়িসুদ্ধ লোকের মায়া বাড়িয়ে দিল…ছোট ছেলেমেয়েগুলো মরছে কেঁদে কেঁদে…
আহা আজকাল আবার বুলি ফুটেছে..কী মিষ্টি করে দাদা-দাদা ডাকে..বুক ঘষটে চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে চলে আসতে শিখেছে তো…সবাইয়ের চোখে পড়ছে।…বড় খাসা ছিরিখানি হয়েছে কিন্তু!
হয়তো এ আক্ষেপের সুর একেবারে ফাঁকা নয়। হয়তো ওই উপহারের সম্ভার ভুয়োনয়। ছোট স্বার্থ ছোট চিন্তা আর ছোট বুদ্ধির সম্বল নিয়ে আবরণ রচনা করে নিজেকে যে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখে মানুষ, সে গণ্ডির বাইরে আছে মানবিকতার নির্মল নীল আকাশ।
কেউ যখন বলে গুডবাই তখন সে গণ্ডিতে ফাটল ধরে, ছোট স্বার্থের আবরণ ভেদ করে সেই গণ্ডির বাইরে গিয়ে পড়ে মানুষ। সেই আকাশে, সেই নীল নির্মলতায়।…
তাই সুমনার ছেলের জন্যে উপঢৌকনের সমারোহও ভুয়ো নয়।
এতদিনের নীচতার আর সংকীর্ণতার অনুতাপ দেখা দিয়েছে লাল হাতি, নীল ঘোড়া, সাদা খরগোশের মূর্তি নিয়ে।
কিন্তু সুমনার ঠোঁটের রক্ত নীল হয়ে উঠছে কেন?
ওই খেলনা পুতুল জামা জুতোর স্থূপের মাঝখানে উদ্দাম খুশিতে পিছলে বেড়ানো ছেলেটাকে ছিনিয়ে তুলে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কেন তার?
যেন ওর প্রাণের পুতুলটিকে ওই অপমানের গ্লানির মধ্যে ডুবে থাকতে দেখতে পারছে না সুমনা।
কী লজ্জা!
কী অপমান!
বড়জেঠি দিয়ে গেছেন একটি কাঠের রাধাকেষ্ট! বলেছেন, পুতুলের ছলে এখন থেকেই রাধাকেষ্টর স্পর্শ পাক।
অথচ সুমনা বসে আছে। সে দৃশ্য দেখছে।
কিন্তু কত আর দেখবে সুমনা?
একসেট নতুন বিছানা আনল সুজাতা। চোখটা ছলছল করে বলল, এটাও বেঁধে দিস সুমি! আহা যেখানে থাকুক ভাল থাকুক।
সুজাতার চোখের কোলে জলের চিকচিকিনি।
না, সুমনার চোখে জল নেই।
সুমনা ধারালো কণ্ঠে বলে ওঠে, কী হবে এসব?
কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে সুজাতা। জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে দেখে। থতমত খেয়ে বলে, কী আর হবে, সঙ্গে দিয়ে দিবি।
মনে রেখো মা, ওকে অনাথ আশ্রমে পাঠানো হচ্ছে। অনাথ কথাটার মানে জানো নিশ্চয়ই? নতুন জামা জুতো বিছানা খেলনার পাহাড় নিয়ে অনাথ আশ্রমে ঢুকতে যাওয়ার মতো নির্লজ্জ ঠাট্টা আর কিছু আছে?…এসব কিছু নেবে না ও। যেমন নিঃসম্বল হয়ে এসেছিল, তেমনি নিঃসম্বল হয়ে চলে যাবে।
সুজাতা ভয় পেল।
সুজাতা অপমানিত হল।
সুজাতা নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সরে গেল। তবু ভাবতে লাগল, ছেলেটা চলে যাবে।
আর ভাবল, আমার মেয়েটা? কী নিষ্ঠুর!
.
চলে যাবে।
কাল চলে যাবে।
সঙ্গে সিদ্ধার্থ যাবে, অলক যাবে, সুমনা যাবে।
সুমনা না হলে কে নেবে দায়িত্ব, সাবধানে পৌঁছে দেবার? সুমনা কুড়িয়ে এনেছিল, সুমনাই যাবে ফেলে দিতে।