সিদ্ধার্থ এক পলক চুপ করে থেকে দৃঢ়স্বরে বলে, এই দেশেই হবে পিসিমা। তবে এ বাড়িতে জায়গা হবে না জানি, তাই নূতন বাসা নিয়েছি।
আচ্ছা ভালই করেছ– সিদ্ধার্থের মা নীরস স্বরে বলেন, বাপভাইকে তুমিই নিজেই বোলো।
আমি বলতে পারব না। কান্তিবাবু একটা মিথ্যে গল্প বানিয়ে ওই ধর্মের ধ্বজা মেয়েকে আর সোহাগের নাতিকে নিয়ে দিব্যি ঘর করছেন। নাতির জুতো আসছে, জামা আসছে, লজ্জার বালাই মাত্তর নেই। সেই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি?
না করে উপায় নেই বলেই করব।
গম্ভীরভাবে বলে সিদ্ধার্থ। হয়তো কথাটা কিছু ভেবেই বলে না। হয়তো শুধু মাকে থামাবার জন্যে বলে। কিন্তু হঠাৎ পিসি ওই কয়েকাক্ষর সংবলিত বাক্যটুকুর গুঢ়ার্থ আবিষ্কার করে চেঁচিয়ে উঠে বলেন, কী বললি?
কী বললাম
ওই মেয়েকে বিয়ে না করে উপায় নেই তোর?
সহসা সিদ্ধার্থের মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। মুখে ফুটে ওঠে একটা সংকল্পের আভাস, তাই স্থির স্বরে বলে, হ্যাঁ তাই-ই।
সিদ্ধার্থের মা কিছুক্ষণ পাথরের মতো অনড় হয়ে তাকিয়ে থেকে বলেন, তাই! তাই অত বুকের পাটা তার! ছি ছি ছি সিধে! তোরা আবার এম. এ., বি. এ. পাসের বড়াই করিস! তোরা আবার শিক্ষার অহংকার করিস। ঘি আর আগুনের হুঁশিয়ারি করতে গেলে বড্ড তোদের অপমান হয়, তাই যে হুঁশ করিয়ে দিতে আসে, তাকে ব্যঙ্গ করিস, বিদ্রূপ করিস, নিচুমন বলিস। ওই মেয়েটার সঙ্গে অত ঘোরাঘুরি দেখে তোর দাদা যেদিন আমাকে দিয়ে বারণ করিয়েছিল, সেদিন দাদাকে যে বড্ড অপদস্থ। করেছিলি? আজ একথা নিজের মুখে কবুল করতে লজ্জা করল না তোর?
সিদ্ধার্থ দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলে, করল না তো দেখছি।
হঠাৎ পিসি বলে ওঠেন,দেখ বউ, ঘরের ছেলে, তাই আমি সন্দেহ ব্যক্ত করিনি। তুমিই বা কী মনে করবে। কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া ছেলে যখন নিজে মুখে কবুল করল, তখন বলি–এ সন্দেহ আমার গোড়াগুড়িই হয়েছিল!
হয়েছিল নাকি! বাঃ। চমৎকার তো!
বলে ব্যঙ্গের একটা তীক্ষ্ণ হুল ফুটিয়ে চলে যায় সিদ্ধার্থ।
ঠিক, ঠিক বলেছে সুমনা।
বিশ্বাস কথাটা একটা অভিধানের শোভা, অর্থহীন শব্দ। বিশ্বাস জিনিসটা একটা শেকড়হীন রঙিন ফুল। ওকে যদি কাঁচের বাটিতে ফটিক জলে ভিজিয়ে রেখে দাও, বাহারের আর শেষ নেই। কিন্তু একটি ফুল তুলতে যাও–ডালপালা সবসুদ্ধ উঠে আসবে।
পিসিমার গোড়াগুড়িই সন্দেহ হয়েছিল! তা হলে মারই বা হতে বাধা কী। হয়তো বাবা দাদা সকলেরই হয়েছে।
এদের কাছে কী মূল্য সিদ্ধার্থের সুনাম-দুর্নামের?
দুটোই সমান।
তবে একটার বিনিময়ে যদি সিদ্ধার্থ খানিকটা সংঘর্ষের হাত এড়াতে পারে, কেন তা করবে না?
৪. বাবা এলেন
বাবা এলেন।
এল দাদারা।
সিদ্ধার্থের মাথা নিচু, কিন্তু কথা স্পষ্ট।
হ্যাঁ! আরও আগেই বলা উচিত ছিল আমার।
তা হলে ওই পুণ্যের নিশানটি সমেতই বিয়ে করছ?
দেখি!
অনেক বড় বড় কথা কয়ে এসেছ চিরদিন, এত ছোট কাজটা করতে লজ্জা করা উচিত ছিল।
সিদ্ধার্থ মাথা তুলে বলে, জীবনে উচিত কাজ কে কটা করতে পারে বাবা? এইবার ভাবছি, দেখি তেমন কাজ একটা করা যায় কি না।
তোমার থেকে যে বংশে এই কলঙ্ক হবে ধারণা করিনি।
ধারণা করেননি? আশ্চর্য তো! গোড়াগুড়িই ধারণা করা উচিত ছিল, চিরদিনই তো আমি আপনাদের কুলাঙ্গার ছেলে।
সিদ্ধার্থ চলে যায়।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন এঁরা।
চরম অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি এমনভাবে মাথা উঁচু করে, আর উপরওলাদের ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করে চলে গেল যে, মনে হল অপরাধী এঁরাই।
কান্তিকুমারও ঠিক ওই একই সময় একই কথা ভাবছিলেন। এ যুগে অপরাধীরাই নিরপরাধীকে ব্যঙ্গ করে বিদ্রূপ করে। তাকেই অপরাধী বানিয়ে ছেড়ে দেয়।
নিজের ঘর সংসারের কথা নিয়ে নয়, একটা কেস নিয়ে ভাবছিলেন।
সহসা ভাবনার জাল ছিঁড়ে একটি নম্র মূর্তি এসে সামনে দাঁড়াল।
সুমনা।
কতদিন পরে বাবার ঘরে এসে দাঁড়াল।
বাবা!
কিছু বলবে?
হ্যাঁ! সুমনা বলল। টেবিলের উপর নখের একটা আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলল, প্রফেসর আর. কের কাছে গিয়েছিলাম।
ভাল।
সুমনা বাবার এই নির্লিপ্ত স্বরের মধ্যে থেকেই বুঝি সাহস সংগ্রহ করে নেয়।
তাই এবার স্পষ্ট গলায় বলে,উনি এখন ইউনিভার্সিটিতে রয়েছেন, আমাকে আসতে বলেছিলেন, নিয়ে নিলেন।
ও! তা হলে ভর্তি হলে? আচ্ছা। ভাল, শুনে সুখী হলাম।
একটু চুপচাপ।
কয়েকটা নিশ্বাসের শব্দ।
তারপর আবার কথার শব্দ।
বাবা, হয়তো তোমাদের খুশি করবার মতো আর একটা খবরও দিতে পারব–তোমাদের
কান্তিকুমার হাতের বই থেকে চোখ তুলে সচেতন হয়ে প্রশ্ন করেন, কী বলছ?
বলছি–খরবটা হয়তো তোমাদের খুশি করবে; ওকে একটা শিশু আশ্রমে রাখবার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। অনাথ আশ্রম বলতে পারল না।
কান্তিকুমার কেমন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের ওই দৃঢ় নম্র মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেমে থেমে বলেন, তুমি! তুমি ব্যবস্থা করেছ? তুমি নিজেই?
টেবিলে আর কয়েকটা আঁকিবুকি পড়ে।
আমি একা নয়, সিদ্ধার্থ সাহায্য করেছে।
সিদ্ধার্থ! সিদ্ধার্থ তোমায় সাহায্য করেছে?
হ্যাঁ বাবা!
কান্তিকুমার যেন মেয়ের দিকে চাইতে পারছেন না, যেন মেয়ের কাছে বড্ড বেশি ছোট হয়ে গেছেন। অথচ উলটোই হওয়া উচিত ছিল তো। কান্তিকুমারই তো পারতেন মেয়েকে ধিক্কার দিয়ে উঠতে। বলতে পারতেন, এই সিদ্ধান্তই যদি করলে, সেটা আমাদের জানালেই কি শোভন হত না? তোমার কাছে এইটুকুর জন্যে যে মাথা খুঁড়ে ফেলেছিলাম আমরা। এখন তুমি পাড়ার ছেলের সাহায্য নিতে গেলে। যেন কত অসহায় তুমি, কত দুঃখী।