বাসা নেবে।
দুজনে পাতবে ছোট সংসার।
না, কান্তিকুমারের কাছে হাত পাতবে না সিদ্ধার্থ। হাত পাততে গেলেই কথা উঠবে উভয় পক্ষের সম্মতির!
সম্মতি!
কোথায় সেই সাপের পা, ব্যাঙের হাঁচি, স্বাতীনক্ষত্রের জল?
অসম্মতি তো অনিবার্য। তা ছাড়া–কী দরকার সেই বর বামুন নাপিত পুরুত, হইহই রইরই!
সুমনার আর রুচি নেই তাতে।
এ বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে তার বিয়েতে যে সমারোহ হবার কথা, তার একটা আভাসময় কল্পনা মনের মধ্যে ছিল সেই কোন ছেলেবেলা থেকে।
ঠাকুমা কান্না ভোলাতে বসলেই বলতেন, সে যা লোক নেমন্তন্ন হবে! কলকাতার শহরে ধরবে না। গয়না যা হবে, এই বড় বড় দশ আলমারি। আলো যা জ্বলবে রাতকে মনে হবে দিন। আর বাজনা যা বাজবে–দেশসুদু লোকের কানে তালা ধরে যাবে
সে বিয়ের সম্ভাবনা সুমনা নিজে নষ্ট করেছে।
আর হয়তো তার প্রয়োজন ঘুচে গেছে। এ বাড়ির ঋণ আকণ্ঠ হয়ে উঠেছে সুমনার। আর বেশি না জমে।
অতএব ওরা নিজেরা বিয়ে করবে।
আর তার আগে একদিন সিদ্ধার্থের সঙ্গে গিয়ে জন্মপরিচয়হীন ছেলেটাকে জন্মপরিচয়হীনের গোত্রে মিলিয়ে দিয়ে আসবে।
করবে মন কেমন হবে কষ্ট। কী আর করা যাবে।
ভুলে যাবে লেখাপড়ার মধ্যে। সত্যি তো আর নিজের নাড়িছেঁড়া ধন নয়।
.
অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল দুজনেই।
সুমনার মনে পড়ল দুটো ছেলেমানুষের কাছে রেখে এসেছে ছেলেটাকে। সিদ্ধার্থের মনে পড়ল, সে এক বন্ধুর উদ্দেশে পাইকপাড়ায় যাচ্ছিল।
.
চোরের মতো ভয়ে ভয়ে ঢুকল সুমনা।
কান পেতে দেখল কোথাও কোনও কান্নার গলা আর্তনাদ করছে কিনা। গুমরে উঠছে কিনা।
না। কোথাও কিছু না।
বরং বড় বেশি যেন নিথর। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।
কিছু বিপদ ঘটেনি তো?
পড়ে যায়নি তো অজীনের হাত থেকে? দেরি হচ্ছে দেখে অঞ্জু দুধ খাওয়াতে গিয়ে টাকরায় সটকে দেয়নি তো?
ওপরে গিয়ে কী দেখবে সুমনা? নিথর ঘুমন্ত একটা শক্ত হয়ে যাওয়া ফুলের দেহ?
শিশু অন্তর্যামী।
তাই কি মুক্তিপিপাসু সুমনার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে তার কাছে? আর ক্ষোভে ধিক্কারে নিজেই। মুক্তি দিয়ে গেছে সে সুমনাকে?
অরুণা!
নিজের গলা নিজের কাছে অপরিচিত ঠেকল। কদর্য ঠেকল।
অরুণাও চমকে তাকাল।
পড়ছিল নীচের দালানে বসে। অবশ্য গল্পের বই। নইলে অত নিবিষ্ট হবার কথা নয়।
কী বলছ দিদি?
কী বলছে।
কী বলতে ডেকেছিল সুমনা?
ও!
বলল, বাড়িটা এত চুপ কেন?
কী জানি। এমনি।
কী জানি। এমনি!
অরুণা কি বাড়ির সমস্ত খবর রাখে?
কী জানি এমনি, মানে? বাড়ির সবাই বাড়িতেই আছে তো?
আছে তো! শুধু জেঠিমা জেঠামশাই পাঠ-বাড়ি থেকে এখনও
জানি। বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় সুমনা।
তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে যায়।
না দেখলে বিশ্বাস নেই।
ঘরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল।
মার কাছে খোকা!
কোলে নয়!
কাছে নিয়ে আগলাচ্ছেন।
সুমনা অস্ফুট মন্তব্য করে, কী হয়েছে?
নাঃ হবে আর কী?
সুজাতা মেয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে গম্ভীর মুখে বলে, তুমি তো আজকাল নিত্যই বেরোচ্ছ, এটাকে অন্তত সারদার মার জিম্মাতেও রেখে যেতে পারো। আমাদের না বলে ছোটদের কাছে রেখে গেলে
না, মরে যায়নি। ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু ঘুমন্ত দেখলেও যে এত মন-কেমন করে তা তো জানত না সুমনা। তবু ছুটে এল না। আস্তে কাছে এসে আস্তে বলল, প্রফেসর আর. কে. সেনের কাছে গিয়েছিলাম, দেরি হয়ে গেল।
সুজাতা চলে যেতে যেতে বলে, প্রফেসর মাস্টার, এদের সঙ্গে এখনও সম্পর্ক আছে তোমার? আমরা তো জানি তোমার ইহকাল পরকাল সবই এখানে বন্ধক দেওয়া হয়ে গেছে!
হ্যাঁ, গিয়েছিল। সহসা সুমনা রুক্ষকণ্ঠে বলে ওঠে, আর থাকবে না। যার জন্যে এত, তাকে এবার বিদেয় করে দিচ্ছি। বলেই
ঘুমন্ত কচি মুখটার দিকে চোখ পড়তেই চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ে তার। সমস্ত রুক্ষতা গলে গলে পড়ে।
.
বাসা নিচ্ছিস? সেই আলাদা বাসায় থাকবি?
সিদ্ধার্থের মা বিস্ময় বিরক্তিতে ফেটে পড়েন, বাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে যাবি?
এইরকমই তো ঠিক করছি।
ঠিক করছিস! একেবারে ঠিক করছিস। হঠাৎ বাড়ির কী অপরাধ হল?
বড্ড বেশি গোলমাল! পড়া হচ্ছে না।
সিদ্ধার্থের মা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলেন,দেখ, তুই আসিসনে আমার সঙ্গে চালাকি করতে। বাড়িতে গোলমাল বলে তুমি আলাদা বাসাভাড়া করছ! এতবার এত একজামিন দিলি, আর এটাই এত বড় হয়ে উঠল! আরও কী মতলব ফেঁদেছিস তাই বল।
এতই যদি বুঝতে পারছ মা, বাকিটাও তা হলে অনুমান করে নাও।
করতে আমার বাকি নেই সিদ্ধি!
সহসা হেসে ওঠে সিদ্ধার্থ।
বলে,মা, তুমি একটা জ্যোতিষালয় খুলে বোসো না কেন? দুদিনে পসার করে ফেলতে পারবে।
সিধু, বাজে কথায় ভাঁওতা দিয়ে আসল কথা চেপে যাচ্ছিস। আমি বলছি, ঠাকুরঝির ভাগ্নের মেয়েকে বিয়ে করো আর না করো–ও মেয়েকে বিয়ে করা চলবে না। কিছুতেই না।
কী যে বলো মা! অচল কীসে! ওরা আমরা এক জাত। ওর বাবা-মানে মর্যাদায়—
জননী গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,তোমার বাপেরও একটা বংশমর্যাদা বলে জিনিস আছে—
সিদ্ধার্থ সহসা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, আছে, অতি উত্তম। কিন্তু কান্তিবাবুর মেয়েকে বিয়ে করলে সে মর্যাদা রসাতলে যাবে কীসে?
জননী কী বলতে যাচ্ছিলেন, অকুস্থলে পিসিমা এসে হাজির হলেন, এবং ঘৃণাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ইতিহাস জানতে তো বাকি নেই, তবে আবার ন্যাকা সাজছিস কেন সিধু? কান্তিবাবুর ও মেয়ের কি আর এদিকে বিয়ে হবে? দূরে বিদেশে-টিদেশে যদি হয়।