কী বাবদ?
ধরো–ওর উপযুক্ত একটা জায়গা–মানে কষ্ট না হয় এ রকম জায়গা।না, গলাটা কাঁপতে দেবে সুমনা, অবাস্তব বুদ্ধি আর অনিষ্টকারী মায়া নিয়ে নিজের কেরিয়ার নষ্ট করবে না। তাই কথা শেষ করে পরিষ্কার গলায়, তোমাকে জোগাড় করে দিতে হবে। আর যাতে মাঝে মাঝে দেখতেনা পাওয়া যায়–
চট করে দানপত্রে সই করে বোসো না সুমনা! বাড়ি গিয়ে ভাবো গে।
ভেবেছি। এখানেই ভেবে নিয়েছি। ভাবাটা আর বাড়ির জন্যে তুলে রাখব না। ওখানে মন দুর্বল হয়ে যায়।
সিদ্ধার্থ এতক্ষণে উপহাসের স্বর ছেড়ে মমতার স্বর ধরে।
বলে, কিন্তু তোমার গলা কাঁপছে।
ওটা সাময়িক।
সুমনা, যদি তুমি মন প্রস্তুত করতে পেরে থাকো, জায়গা খুঁজতে সময় লাগবে না। এতদিন ধরে ওই সন্ধানই করে বেড়াচ্ছি।
কেন বলো তো? সুমনা বিস্মিত হয়। আমি তো তোমাকে বলিনি। বাবা কি
না সুমনা! কান্তিকাকা আমায় কিছুই বলেননি। আমি এমনি, হঠাৎ একদিন কী খেয়াল হল, ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে সিদ্ধার্থ, ভাবতে শুরু করলাম–যদি তুমি বিয়ে নামক ব্যাপারটাকে একেবারে অর্থহীন অবান্তর বলে উড়িয়ে না দাও, যদি ওকে কাছছাড়া করতে রাজি হও–আমি এ সমস্তই যদির ওপরে ভেবেছি সুমনা, রাগ কোরো না তুমি–হ্যাঁ, যদি রাজি হও, তা হলে তখন যেন আবার খুঁজে বেড়ানোর দুর্ভোগ না পোহাতে হয়। তাই
সুমনা একটু চুপ করে থাকে।
কী বলতে গিয়ে থামে।
তারপর আস্তে আস্তে থেমে থেমে বলে, সে রকম ভালমতো কোথাও দেখেছ নাকি?
তারা তো অনেক ভাল ভাল কথাই বলল।
কী বললে তুমি?
বললাম? যা সত্যি তাই বললাম। শুধু সময়টার একটু হেরফের করলাম আর কি। অতদিন আগে না বলে বললাম সম্প্রতি পাওয়া গেছে
সুমনার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে কেন? সেই ক্ষীণ গলা থেকে প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বাস করল?
এক কথায় করে না। অনেক বলতে হয়েছে। আরও অনেক প্রমাণের দরকার। কিন্তু ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ কথা হবে? চলোনা কোথাও গিয়ে বসা তোক একটু।
কোথায়?
ধরো কোয়ালিটিতে। যেটা কাছাকাছি হবে।
কোয়ালিটিতে!
সিদ্ধার্থ আর সুমনা। গিয়ে বসবে, আগে আগে লুকিয়ে এক-আধদিন যেখানে এসে বসত।
এসব এখনও আছে পৃথিবীতে?
সুমনা ভুলে যায় অজীন আর অঞ্জনাকে একটু দেখতে বলে চুপি চুপি এসেছে সে, ঘণ্টাখানেকের জন্যে।
ভুলে যায় প্রফেসরের কাছে কেটে গেছে দেড় ঘণ্টার উপর। ভুলে যায় সিদ্ধার্থের সঙ্গে শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেটে গেল আধ ঘণ্টাটাক, আর ভুলে যায় চা খেতে ঢুকলে আরও কতখানি সময় হারানো। সময় গড়িয়ে পড়ে যাবে বিকেলের গা থেকে।
চা-টা উপলক্ষ।
তবু সিদ্ধার্থ জোর করে খাওয়ায় কিছু। তারপর পরামর্শে আর আলোচনায় গম্ভীর হয়ে ওঠে।
ও বাড়িতে আর ভাল লাগে না সুমনার।
চিরকালের জায়গা যেন অপরিচয়ের বর্ম পরেছে।
কে জানে শুধু সুমনারই এরকম অনুভূতি, না সব মেয়েরই হয়। বিয়ে না হওয়া বড় মেয়েদের!
হয়! সবাই জানে সে কথা।
সুমনা জানে না। সুমনা জানত না। বড় হয়ে যাওয়া মেয়েদের মতো ছিল না সুমনা।
এখন সুমনা ভাবে, শুধু তারই মনে হচ্ছে বাড়িটা যেন পরের। বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে সুমনাকে। কী গ্লানি, কী যন্ত্রণা!
কান্তিকুমার মুখের ওপর একটা স্নেহহীনতার আবরণ পরে ঘুরে বেড়ান, সুজাতা প্রতি পদে কপালে করাঘাত করে আর সুমনার বুদ্ধিকে ধিক্কার দেয়। বাড়ির লোকেদের চোখে ক্রমশই একটা অনমনীয় সংকল্পের দৃঢ়তা। ঘোটরা কাছে আসতে চায়, কিন্তু বোধ করি উপরওলাদের নিষেধে থতমত খায়।
অসহ্য!
বড় অসহ্য!
যাকে নিয়ে এত গোলমাল, তাকে বিদায় করে দিলেই হয়তো আবার আস্তে আস্তে ওরা প্রসন্ন হবে।
হয়তো বাবা বলবেন, সুমি, আজ তোর কটায় ক্লাস? গাড়িকে বলে রাখব।
হয়তো মা বলবে, মনটা খারাপ লাগছে? চল একটু তোর মেজোমাসির বাড়ি বেড়িয়ে আসি।
হয়তো ছোটকাকাও বলবেন, সুমিটার চেহারাটা বিশ্রী হয়ে গেছে, ওকে একটু দেখাশোনা কোরো বউদি।
আর হয়তো ঠাকুমা বলবেন, মনা, আয়না কাছে। একটু বোস না। কদিন তোর মুখে একটু ঠাকুর দেবতার গান শুনিনি।
হয়তো এ সমস্তই হবে।
কিন্তু সুমনার আর ভাল লাগবে না। সুমনার চোখে ধরা পড়ে গেছে সবকিছুর ফাঁকি। জেনে ফেলা হয়ে গেছে কীসের কী মূল্য।
তাই, আবার যদি সেই মূল্যহীনতার বোঝাকে পরম মূল্যবানের ভানে বয়ে মরতে হয়, তার চাইতে যন্ত্রণা আর নেই।
টিকতে পারবে না।
আর সেই ছোট্ট ঘরখানার বিরাট শূন্যতা!
সেও কি অহরহ গ্রাস করতে আসবে না সুমনাকে?
কিন্তু এ বাড়িতেও সুমনাকে নেবে না।
সিদ্ধার্থর বাড়িতে। সুমনা বুঝতে শিখেছে।
শুধু সুমনার বুঝতে শেখা নয়, নিজের মুখে বলতেও লজ্জা পায় না সিদ্ধার্থ। বলে, তোমার হিতৈষিণী জেঠিমা যা একখানি ছুরি বসিয়ে রেখেছেন, তাকে টেনে তুলতে গেলেই রক্তপাত! রোগীর মৃত্যু। অতএব
অতএব কী করা, সেই আলোচনাতেই কেটে যায় ঘন্টার পর ঘণ্টা।
বিকেল গিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে।
স্থির হয়, বিয়েটার আর দেরি করা নয়।
ওটা করে ফেলে ঘাঁটি শক্ত করে নিয়ে ছোট একটি ফ্ল্যাট নেবে সিদ্ধার্থ!
কোথায় পাবে?
তাও আছে তার সন্ধানে।
এক বন্ধুর বাসার বড় ভাড়া বেশি। দুখানা ঘর বিলি করতে চায় সে। অবশ্য বাড়িওলার চোখে ধুলো দিয়ে।
হোক! অত সততায় কাজ নেই। ইদানীং তো এই তালেই ঘুরছে সিদ্ধার্থ। সামনেই যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পরীক্ষা তার, তা খেয়ালও করছে না।