থাম দাদা! সুমনা প্রায় ধমকে ওঠে, তোর সিদ্ধার্থ দেখছি অনেক কথা শিখেছে।
কিন্তু তুইও তো যা তা করছিস মনা। এম. এ-তে ভর্তি হলি না, বাড়ির কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস না
বাড়ির কেউও আমার সঙ্গে রাখে না।
বেশ তাই সই! অলক বলে, কিন্তু সিদ্ধার্থ? সে বেচারার কী দোষ? কী যন্ত্রণা তার! এদিকে এই, ওদিকে বাড়িতে বিয়ের জন্যে উৎপাত করছে–
বাঃ চমৎকার! সুখবর তো! তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দে না। পাড়ার একটা ঘটার বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়া যাবে।
নাঃ সত্যিই তুই ভারী নিষ্ঠুর হয়ে গেছিস মনা! আগে এমন ছিলি না। আচ্ছা, বিয়ে-টিয়ে হওয়া, মানে সত্যি মা-হওয়া মেয়েও তো কত দেখেছি তারা তো পড়ছে লিখছে খেলছে গান গাইছে, সবই করছে। তোর মতন তো এমন জড়ভরত হয়ে ঘরে বসে থাকছে না।
থাকে না, তা জানি—
সুমনার উত্তর দেওয়া হয় না।
ছেলেটা হামা দেবার চেষ্টায় মুখ তুলতে গিয়ে থুবড়ে পড়ে গিয়ে ককিয়ে কেঁদে ওঠে। সরবে ছেলে ভোলাবার অভ্যাস সুমনার নেই, অনেক দুলিয়ে থাবড়ে চুপ করিয়ে বলে,দেখলি তো? কী অবস্থা! সবাইয়েরই অনেক আত্ম-পরিজন আছে, এ বেচারার আমি ছাড়া আর কে আছে বল?
তা মেজোকাকা তো ঝি রাখতে চেয়েছিলেন, তুই নাকি রাজি হোসনি?
আচ্ছা দাদা, ঝি কি যত্ন করতে পারে?
কেন পারবে না? শুধু তোর মতন মোমের পুতুল মায়েদের কাছেই পারে না। সত্যি সিদ্ধার্থ বলছিল–
ও বুঝি তোকে উকিল খাড়া করেছে রে দাদা?
তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে ওঠে সুমনা।
অলক বলে, আমি কারও উকিল-টুকিল নই। নিজেই জজ। আমার মনে হয় তোর খুব ভুল হচ্ছে। এই তো তোদের প্রফেসর আর. কে. সেনের সঙ্গে দেখা হল সকালে। তুই ভর্তি হোসনি শুনে হায় হায় করতে লাগলেন, কারণ জানতে চাইলেন। কী আর বলি বল? বললাম, শরীর খারাপ। শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। কী হয়েছে, কোনও ডাক্তার দেখছে, পরীক্ষার আগে থেকেই তো ভুগছিল, এখনও সারছে না কেন, ডাক্তাররা কী বলছে, এই সব বহু প্রশ্ন।..কী করে যে পাশ কাটিয়ে উত্তর দিয়ে এসেছি! আরও বললেন, তাই রেজাল্ট বেরোবার পর দেখা করতে আসতে পারেনি। অথচ আমি ভাবছি। নিজেই একদিন আসতে পারেন বললেন।
অলক খানিক পরে উঠে যায়।
একমাত্র যে মানুষটা সুমনার কাছে বাইরের বাতাস একঝলক করে এনে ছড়িয়ে দিয়ে যায় মাঝে মাঝে।
.
ও চলে যায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমনা। বসে বসে ভাবে।
প্রফেসর আর. কে. সেন!
দেবতার মতো যাঁকে ভক্তি করত সুমনা।
করত!
হ্যাঁ, করত ছাড়া আর কী!
সুমনার জীবনে বর্তমান বলে আর কিছু নেই। সবই অতীত হয়ে গেছে। নইলে প্রফেসর সেনকে সে প্রণাম করতে যায়নি পাস করার পর। করবার কথাও মনে পড়েনি।
সুমনা কি জানোয়ার হয়ে গেছে? তাই পৃথিবীতে মানুষ আছে–এ কথা ভুলে গিয়ে গুহাবাসীর জীবন যাপন করছে কেন?
হঠাৎ এই প্রথম ছেলেটার ওপর ভয়ানক একটা আক্রোশ আসে সুমনার। মনে হয় শত্ৰু, শত্রু, পরম শত্রু ও সুমনার।
অথচ এই শত্রুর শত্রুতার বিরুদ্ধে কিছু করবার নেই। নিরুপায় আত্মসমর্পণে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে চলতে হচ্ছে।
আত্মহত্যা বইকী!
নইলে সিদ্ধার্থকে অকারণে অপমান করে বিদায় দিতে পারে!
সিদ্ধার্থের প্রতীক্ষার প্রহর ব্যর্থ করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে?
অনেকক্ষণ ভাবে।
অতঃপর ঠিক করে, এই একটা অনির্দিষ্ট অনিশ্চিতের মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া চলবে না। একটা কিছু করতে হবে।
এই জানোয়ারের মতো গুহার জীবন আর নয়।
.প্রফেসর তাঁর পাকা চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে মৃদুগম্ভীর স্বরে এলেন, স্ট্রেঞ্জ! তোমার দাদা তো এসব কিছুই বলল না আমায়।
ওর লজ্জা করেছিল।
মাথা নিচু করে বলে সুমনা।
প্রফেসর বলেন, তুমি আমার কাছে তোমার অসুবিধের কথা বললে বলেই এ কথা বলছি, আমার মনে হয় প্রথমেই তোমার বাবার পরামর্শই নেওয়া উচিত ছিল তোমার। অথবা তাঁর পক্ষেই উচিত ছিল তোমার সেন্টিমেন্টের বশে না চলে, জোর করে ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলা। পরিত্যক্ত শিশুদের জন্যে গভর্নমেন্ট থেকে ব্যবস্থা আছে বহু সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান আছে, অনাথ আশ্রম আছে, খোঁজখবর করে যে কোনও এক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। মায়া পড়ে গেছে সত্যি কথা। পড়াই স্বাভাবিক। মেয়ে-মনের কাছে একটি অসহায় শিশু! কিন্তু সুমনা, যে মায়া তোমার জীবনে অকল্যাণ ডেকে আনবে তাকে তো প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। তোমার কেরিয়ার, তোমার পারিবারিক জীবন, তোমার বিবাহিত জীবনের ভবিষ্যৎ, সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত করে এভাবে জড়িয়ে পড়বে কেন তুমি, তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তুমি এমন একটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, এই অদ্ভুত কারণে তুমি পড়া ছেড়ে দিলে! এক্ষুনি একটা যা হোক চাকরি করতে চাইছ! এ কী! আমরা জানি তুমি পড়বে, পাশ করবে, রিসার্চ করবে, রীতিমত একটা কেরিয়ার গড়ে নেবে। তা নয়–নো নো, মাই গার্ল! তোমার মতো ইনটেলিজেন্ট মেয়ের পক্ষে এ একটা অদ্ভুত অবাস্তব কল্পনা যে, যে কাজটা একটা সাধারণ দাই বা ঝিকে দিয়ে হতে পারে, সেই কাজটার জন্যে তোমার অমূল্য সময়টা নষ্ট করবে তুমি।
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমনা।
প্রফেসরের যুক্তির মধ্যে ও যেন নিজের কল্পনার অবাস্তবতাটা সুস্পষ্ট দেখতে পায়। কান্তিকুমার যখন বলেছেন, বুঝিয়েছেন, তখন সুমনা শুনেছে মনের মধ্যে একটা বিরুদ্ধ ভাব নিয়ে। সমস্ত যুক্তি