সুমনা মায়ের মুখের দিকে তাকায়, মার প্রত্যাশাপূর্ণ কাতর মুখের দিকে। দেখে মায়াও হয়। বুঝতে পারে, তার অল্পবুদ্ধি ভালমানুষ মা মনে করছে, এই অস্ত্রে মেয়েকে কাবু করে ফেলতে পেরেছে, তাই মুখে ওই প্রত্যাশার ছাপ।
কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণের উপায় সুমনার হাতে নেই। তাই সুমনা মার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, কিন্তু আমি শুধু মেয়েমানুষইনই মা, মানুষও। মানুষের ধর্মে মানুষের নীতিতে যদি মেয়েমানুষের নীতি-ধর্মে সংঘর্ষ হয়, মানুষের নীতিটাই গ্রহণ করতে হবে।
সুজাতা স্বামীর মতো মেয়ের মতো অত ভাল ভাল কথা বলতে জানে না। সোজা কথাই সতেজে বলে, তা রাজ্যিসুদু মানুষ তোর মতো করছে?
সকলের জীবনে একই সমস্যা এসে পড়ে না মা!
সুজাতা এইবার নিজের চিন্তার কথাই খোলাখুলি বলে, সংসারটি তো শুধু আমার নয় সুমি যে, সেখানে মানুষের ধর্ম, দয়া ধর্ম, সব কিছু চালাতে বসব? পাঁচজনে যখন পাঁচ কথা বলবে?
কথা তো একটা অদৃশ্য পদার্থ মা! সুমনা হেসে ওঠে,ওকে বস্তু মনে করে কষ্ট না পেলেই হল। বলুক না পাঁচজনে পাঁচশো কথা!
সুজাতা তীব্র স্বরে বলে, বাতাসও একটা অদৃশ্য পদার্থ সুমি! কিন্তু সেই অদৃশ্যটা যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সেটা ঝড়, তাকে আর অদৃশ্য বলে অগ্রাহ্য করা যায় না, বুঝলি?
সুমনা এক মিনিট চুপ করে থেকে বলে,আমি তো বাবাকে বলছি মা, আমায় তোমরা ত্যাগ করো!
বাবাকে বলছি, আমায় ত্যাগ করো!
সুজাতা স্তম্ভিত হয়ে বলে, এই কথা বলেছিস তুই ওঁকে?
তা আর যখন পথ দেখছি না। সংসারের পাঁচজনের কাছে মুখ থাকাটাই যখন তোমাদের কাছে প্রধান প্রশ্ন, তখন
বুঝেছি! তাই মানুষটা অমন কাঠ হয়ে গেছে। দয়া ধর্মের কথা বলছিস সুমি, ওঁর মুখের উপর ওই কথাটা বলতে তোর দয়া ধর্মে বাধল না?
সুমনা চুপ করে থাকে।
সুজাতা গম্ভীর ভাবে বলে, এতবড় কথাটাই যখন বলতে পেরেছিস সুমি, তখন আমিও বলি, ত্যাগ করলে তোর ওই ওটাকে নিয়ে এত আদর আদিখ্যেতা চলবে কীসের উপর?
ভাবছি ভাগ্যটাকে একবার দেখি না?
ও! তা সেটা দেখবি একটা পথে-পড়ে-থাকা হতভাগার সঙ্গে ভাগ্যকে জুড়ে?ভালমানুষ হলেও, সরল হলেও, মরিয়া বলে একটা কথা আছে। সুজাতা মরিয়া হয়ে উঠেছে বলেই ওর মুখে তীব্র ব্যঙ্গের ভাষা ফোটে। তার ভাগ্য তো চোখের উপরই দেখলে? সেই অবস্থাটা নিজেরও চাও? তোমার মতন বয়েসের একটা মেয়ে ওইরকম একটা বোঝা কাঁধে নিয়ে, ঘরবাড়ি মা বাপের আশ্রয় ত্যাগ করলে, তার বি. এ., এম. এ. পাস খুব বেশি কাজে লাগে না সুমি! পথ থেকে রসাতলের পথে যেতে হয়।
তা বুঝব, সেটাও ভাগ্য!
তবু নিজের গোঁ ছাড়বি না? লক্ষ্মীছাড়া মুখ মেয়ে।
গালাগাল দিচ্ছ? সুমনা হেসে ওঠে, তা দাও, মস্ত একটা লাভও আমার হচ্ছে মা। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। ধরতে পারছি, স্নেহ কী, ভালবাসা কী, কোথায় তার শিকড়, কী তার মূল্য।
অদ্ভুত কঠিন দেখায় সুমনার ওই হাসিমাখা মুখটা।
সুজাতা মেয়ের ওই পরিচিত কঠিন মুখটার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠে যায়।
মা চলে যেতে সুমনাও আস্তে আস্তে ঘরের কোণের দিকে সরে আসে। দেখে, যে প্রাণীটাকে নিয়ে এত সমস্যা, এত সংঘর্ষ, এত হৃদয়-দ্বন্দ্ব, সে ঘুমিয়ে আছে অঘোরে; পৃথিবীর সমস্ত ধূলি মালিন্যের অতীত দেবতার মতো মুখখানি নিয়ে।
আশ্চর্য!
মানুষ কী ছোট!
বুদ্ধি পাণ্ডিত্য শিক্ষা সভ্যতা, দয়া ধর্ম মনুষ্যত্ব, কত কিছুরই বড়াই তার!
তবু কী ছোট!
এত ছোট যে, এতটুকু এটুকু ছোট্ট জিনিস সহ্য করে নেবার শক্তি নেই তার।
.
সুজাতা এই দেড় মাসের পাতানো সংসারটাকে গুটিয়ে তুলতে তুলতে চোখের জলে ভাসছিল।
কী কুক্ষণেই এসেছিল সে এই শিমুলতলিতে মেয়ের শরীর সারাতে। বলতে গেলে একরকম জোর করেই এসেছিল।
ছোট মেয়ে অঞ্জনার স্কুল পরীক্ষা সামনে, অভীক অজীন দুই দুরন্ত ছেলে, তাদের দায়িত্ব জা-শাশুড়ির ওপর চাপিয়ে চলে আসতে চাওয়ায় খুব একটা প্রসন্নও ছিল না কেউ; কান্তিকুমারও বলেছিলেন,ওদের রেখে যাওয়া–তার চাইতে সুমিকে নিয়ে আমিই বরং একা কোথাও।
সুজাতা ঝংকার দিয়ে বলেছিল, তুমি একা কোথায় নিয়ে যাবে শুনি? যেখানেই যাও, উঠবে তো সেই হোটেলে? সেখানের রান্না ওর সহ্য হবে? রোগ ধরার মূল কারণটিই তো ওই। ভুলে যাচ্ছ বুঝি?
ভুলেই গিয়েছিলেন।
মনে পড়ল কান্তিকুমারের।
গত পুজোর সময় দুই মেয়ে আর দুই ভাইঝিকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে রাঁচি বেড়াতে গিয়েছিলেন। অতএব হোটেল ছাড়া আর গতি কী।
তা সেই হোটেলের ঝালমসলা সংযুক্ত রান্না আর শক্ত ভাতই নাকি সুমনার স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণ। অন্তত সুজাতার তাই ধারণা। কান্তিকুমার অতএব চুপ।
সুজাতা নিজের স্বপক্ষে আরও যুক্তি খাড়া করেছিল, ছেলেমেয়ে তিনটিকে রেখে যেতে তোমার তো ভাবনার শেষ নেই, একান্নবর্তীতে থাকার আর সুখটা কী তা হলে? আমাকে বারোমাস অন্যের দায় পোহাতে হচ্ছে না? এই যে ছোটবউ যখন-তখন বাপের বাড়ি চলে যায়, থাকে না ওর মেয়ে? স্কুলের ছুটি-অছুটি বাছে ছোটবউ? দিদি যে সমস্ত পালা পার্বণে গুরু আশ্রমে যাচ্ছেন, থাকে না ওঁর ছেলেটি?
কান্তিকুমার এত খোলাখুলি এইসব স্কুল কথা আদৌ সহ্য করতে পারেন না, অথচ সুজাতার কথার এই-ই ধরন।
ও স্বামীর কাছে যা বলে স্পষ্ট বলে।