আহা-হা তা বলছি না। মানে, আমি বলতে চাইছি–মেয়েরা তো চিরদিনই একটু টক ঝাল নুন মশলার ভক্ত। আর তুমিও নিশ্চয় মেয়ে ছাড়া আর কিছু নও? অতএব নির্বিদ আলু-ভাতে অভিরুচি না হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই একটু আধটু অশান্তির চাষ
দুটি ভাই সমান! খালি বাক্য। পষ্ট কথা বলি শোনোসুমনার বিরুদ্ধে তো সবাই লড়তে শুরু করেছে। আমারও যুক্তিটুক্তি তেমন আসছে না। তা ওকেই বিয়ে করবে এটাই একেবারে স্থির?
সে যদি করে।
সেই তো কথা। কিন্তু এ সন্দেহ নিয়ে–?
তা যেখানেই আশা সেখানেই সন্দেহ।
কিন্তু ওর সম্বন্ধে তো এ পক্ষে একেবারে
তাতেই তো আরও মজা পাচ্ছি।
মজা পাচ্ছ।
হ্যাঁ। তাই! নিজেকে বেশ বীরপুরুষ বীরপুরুষ মনে হচ্ছে।
ওকে না হলে তা হলে চলবেই না তোমার?
আপাতত তো তাই মনে হচ্ছে।
মা তো কান্না জুড়েছেন।
কাঁদুনে বাচ্চারা যেমন কাঁদে, তেমনি সহজে ভোলে।
অতঃপর হঠাৎ কেমন করে যেন আলোচনার নৌকো উলটো দিকে বয়, এবং বউদিই পরামর্শ দিয়ে বসেন–তার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াই হল ঠিক ব্যবস্থা। তাতে প্রথমটা সবাই একটু বিচলিত হলেও কালে ভবিষ্যতে সেটাই ভাল হবে। মনে কোরো না আমি একলা একেশ্বরী হয়ে থাকতে চাই বলেই এ কথা বলছি। আমি শুধু বলতে চাইছি বিয়ে করবার সময় যে শপথ মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, তাতে বারবার বলা হয়–তোমাকে সুখে রাখব, সম্মানে রাখব…ইত্যাদি!তা ভাই সে সব শপথ আর কজন রাখে বলো? রাখে না তার কারণ এই একান্নবর্তী পরিবার। এর জাঁতার চাপে ছোট বড় কারও জীবনের বিকাশ নেই। প্রত্যেকের পর্বতপ্রমাণ অসন্তোষ। বড়রা ভাবে ছোটরা অকৃতজ্ঞ, ছোটরা ভাবে বড়রা অবিচারক।
ওরে বাবা, তুমি যে দেখছি অনেকদূর অবধি ভেবে ফেলেছ। যাক–তোমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাব।
রমলা দুষ্টু হাসি হেসে বলে, কিন্তু ঠাকুরপো, তোমার পড়শিনী কি সত্যিই তোমায় ভালবাসে? না কি এতদিন শুধু তোমায় নিয়ে খেলিয়েছে?
সিদ্ধার্থ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রমলার দিকে।
বলে, কী করে বুঝব বলো? দেবা ন জানন্তি বলে একটা কথা আছে। তবে তোমরা জানলেও জানতে পারো। স্বজাতির হৃদয়রহস্য ভেদ করা হয়তো সম্ভব হতেও পারে। খেলানো ব্যাপারটার রীতিপদ্ধতি তোমরাই—
আহা-হা! আমাদের সঙ্গে তুলনা! আমরা আবার মানুষ নাকি? বাবা গোরুখখাঁজা করে একটি জামাই খুঁজে বার করে মেয়েকে তার গোয়ালে সমর্পণ করে দিয়ে গেছেন, সেই গোয়ালে পড়ে আছি আর সেই পরম গোরুর চরণে জীবন যৌবন উৎসর্গ করে ধন্য হচ্ছি। আমরা আবার খেলাবার রীতি পদ্ধতির খবর রাখতে যাব।
ইস বেচারা! বাবার অবিমৃষ্যকারিতায় জীবনটাই বরবাদ।
তা প্রায় তাই। তবে কি জানো ভাই,জীবনটাকে নিজের এক্তারে পেলেই যে কী হত সে কথা বলা শক্ত। হয়তো বাঁদরের হাতে খোন্তা হত। এই যে সুমনা, আসলে রহস্যটা যে কী বোঝাই তো শক্ত। আমি তো আগে কিছুতেই বিশ্বাস করিনি, কিন্তু পিসিমা-টিসিমা যা সব অকাট্য যুক্তি দিচ্ছেন
সহসা গম্ভীর হয়ে যায় সিদ্ধার্থ।
বলে,ছিঃ বউদি! তোমার কাছে অন্তত এ ধরনের কথা শুনব আশা করিনি।
কী, জানি ভাই, এমন সব বলছেন এঁরা– বলে অপ্রতিভ হয়ে সরে যায় রমলা।
সিদ্ধার্থও বেরিয়ে পড়ে।
দুর ছাই!
অকারণে জীবনটা কী এক অদ্ভুত জটিলতার জালেই জড়িয়ে গেল! এ জাল থেকে মুক্ত হবার যে কী উপায়!
.
এই যে শ্রীমান অচিনকুমার
অলক লা ল লা লা লা করতে করতে সুমনার ঘরে ঢুকে বলে, আরে আরে এটা মাটিতে পড়ে কেন?
কাছেই বসে আছে সুমনা।
তাকিয়ে দেখে বলে, এত দুষ্টু হয়েছে যে এক মিনিট খাটে রাখতে পারা যাচ্ছে না। এই দেখো না কাল পড়ে কপাল ফুলিয়েছে।
তা দোলায় তুলে রাখলেই তো হয়–
ছেলেটাকে টপাস করে তুলে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলে অলক, দোলা থেকে ট্যাঁ ফোঁটি করতে পারে না।
দোলা। দোলনা।
কত সাধ সুমনার!
কত স্বপ্ন!
দোলনায় শুইয়ে দোলা দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াবে তার অচিনকে, খোকনকে, মানিককে। কিন্তু সে সাধের কথা বলবে কাকে?
কান্তিকুমার জামা তোয়ালে বিছানা অয়েলক্লথ ফুড় ফিডিংবটল এসব জুগিয়ে আসছেন, তা বলে দোলার কথা তাঁর মনে পড়বার কথা নয়।
ফিকে একটু হাসে সুমনা। বলে দোলনা কই?
দোলনা নেই! অলক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, ইস! পুওর বেবি! ঠিক আছে, আমিই ওকে একটা দোলনা প্রেজেন্ট করব!
থাক দাদা। আর গোলমাল বাড়াসনে। ভিখিরিদের ঘরের ছেলে ভিখিরির মতনই মানুষ হোক।
ভিখিরির ঘরের? কে বলে?অলক সেই মোমের পুতুলটাকে যত লোফালুফি করে ততই খিলখিল হাসিতে ঘর ভরিয়ে তোলে সে। আরও ছুঁড়ে দিয়ে বলে অলক, এ বেটা নির্ঘাত কোনও রাজবাড়ির ছাঁ। দেখছিস না কী কার্তিকের মতন মুখ, কী সোনার মতন রং!
ওর সত্যিকার মা জানবেও না ও বেঁচে আছে, বড় হচ্ছে। হয়তো চোখের সামনে দেখলেও চিনতে পারবে না। ভাবলে কী অবাক লাগে, না রে দাদা?
তা লাগে। অলক ছেলেটাকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ভাবলে কত কীই অবাক লাগে। এই যে তুই দুদিনের জন্যে বেড়াতে গিয়ে কার না কার একটা জিনিস কুড়িয়ে এনে তার জন্যে সবত্যাগ করছিস, এও একটা পরম আশ্চয্যি। সিদ্ধার্থ তো বলছে তুই পাগল হয়ে গেছিস। বলছে, যে মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বের অংশ বেশি, তাদের নাকি খুব ছেলেবেলায় বিয়ে-টিয়ে হয়ে বাচ্চাটাচ্ছা হয়ে গেলেই মঙ্গল। নইলে এই রকম সব ম্যানিয়া–