তার মানে উনি কথা দিয়ে আসার পরও তুই ওঁর মুখ রাখবি না?
রাখা সম্ভব নয়।
আর আমি যদি তোকে হুকুম করি?
বলে একটি গর্বিত সাফল্যের দৃষ্টিতে তাকালেন মা।
হু বাবা! এইবার? কেমন প্যাঁচে ফেলেছি।
কিন্তু ধূলিসাৎ হল গর্ব।
সিদ্ধার্থ বলল, হুকুম তুমি করতে পারবেই না মা! হুকুম করবার আগে তো এ সাহস থাকা চাই যে, হুকুমটা রক্ষা হবেই।
বুকের উপর একটা হাতুড়ির ঘা বসিয়ে চলে গেল ছেলে! চোখের জল গোপন করতেই বুঝি আড়ালে সরে গেলেন সিদ্ধার্থের মা অনুপমা। আর সেই আড়ালে বসে ভাবতে লাগলেন, কী করে এমন বদলে যায় ছেলেরা? একদা যে মা থাকে সবচেয়ে ভালবাসার, সব বড় আশ্রয়, সেই মা এত তুচ্ছ হয়ে যায়? স্নেহ ভালবাসা শ্রদ্ধা সন্ত্ৰম কর্তব্য অকর্তব্য, ভাল দেখানো মন্দ দেখানো–সমস্ত কিছু পরাস্ত হয় যৌবনের উদগ্র বাসনার কাছে?
ভগবান, ছেলেরা কেন বড় হয়ে যায়। কেন যুবক হয়ে ওঠে? যদি তাই হয়, তবে এমন নিয়ম কেন নেই, ছেলেরা বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের প্রাণ থেকে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তার জন্যে আকুলতা, তার প্রতি আশা। পশুপক্ষী কীট-পতঙ্গ জীবজগতের সকলের যা নিয়ম, সে নিয়ম কেন মানুষের মধ্যেও রইল না? ছেলেদের মধ্যে তো জীবজগতের রীতিনীতি। শুধু এই অবুঝ অজ্ঞান মা-গুলোর মধ্যেই
এই তো বড় ছেলে অমিতাভ!
বিয়ের আগে পর্যন্ত কী ন্যাওটাই ছিল মার। ছোট থেকে সবাই বলত মায়ের ছায়া।
সিদ্ধার্থটাই বরং চিরকেলে ডাকাবুকো।
কিন্তু সেই মা-ন্যাওটা বড় ছেলে কী বদলেই গেছে! মা বলে প্রাণীটার প্রতি সেই একান্ত নির্ভরতার ভাব তো চুলোয় গেছেই, উলটে উঠতে বসতে ছুতো খুঁজে বেড়ায় কী করে মার একটু দোষ আবিষ্কার করবে।
কেন?
সে এক রহস্য।
আগে বুঝতে পারতেন না, অবিরত শুধু অবাক হতেন, আর কেন কেন করে অন্ধকারে মাথা খুঁড়তেন। ক্রমশ রহস্যভেদ হয়েছে। ভাবতে ভাবতে কারণটা আবিষ্কার করতে পেরেছেন।
আর কিছু নয়। মায়ের ত্রুটি ধরা পড়লে বউয়ের ত্রুটির ওজনটা খানিকটা হালকা হয়ে যায়। বউয়ের যে প্রতি পদেই ত্রুটি, সেটা চোখ বুজে অস্বীকার করতে চাইলেও, মনের অগোচর তো চিন্তা নেই।
বড় ছেলেকে তাই অনুপমা খরচের খাতায় লিখে রেখেছিলেন। সেজো মেজো বিদেশে। ডাকাবুকো ছেলে সিধুটাই ছিল ভরসা। মনে করতেন ও ওরকম করবে না। যেমন মানুষ প্রতিনিয়তই মৃত্যু দেখেও ধারণা করতে শেখে না, আমার প্রিয়জনেরও মৃত্যু হবে। যে কোনও মুহূর্তেই সে ঘটনা ঘটতে পারে।
ওর গেছে, তা বলে কি আমার যাবে?
একজন মন্দ হয়েছে, তা বলে কি আর একজনও মন্দ হবে?
কিন্তু সিদ্ধার্থ বুকে হাতুড়ি মেরে সেই অবোধ ভুল ভেঙে দিয়ে গেল। অনুপমা অনুভব করলেন সিদ্ধার্থ আর তাঁর নেই।
জয় হয়েছে যৌবনের।
তৃষ্ণার জলের চাইতে নেশার মদের আকর্ষণ অনেক প্রবল, প্রমাণ হয়ে গেছে একথা। তবে আর কী করবার আছে?
.
বড় বউ রমলাকে কিন্তু অনুপমা যত স্বার্থপর আর মমতাহীন ভাবেন, সে তা নয়। অনুপমার মনের গতিবিধির খবর সে রাখে, চেষ্টা করে সেই ক্ষুব্ধ চিত্তে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে। কিন্তু চেষ্টাটা কার্যকরী হয় না। যেখানে ছেলে দূরে সরে যেতে চায়, সেখানে বউয়ের সাধ্য কি যোগাযোগের সেতু রচনা করে?
তবু সে অমিতাভর কাছে গিয়ে অভিযোগ করে, বেশ তো নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছ, ওদিকে মা তো কান্নাকাটি করছেন।
কেন? হঠাৎ কান্নাকাটির কী হল?
আর কি? তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতার ব্যাপার। কান্তিবাবুর মেয়ে ব্যতীত তার জীবন অচল, ওদিকে মা–
তা এসবের মধ্যে আমি কে? আমি তো আগেই রায় দিয়ে রেখেছি।
শুধু রায় দিলেই হয় না। ভাইকে বোঝাতে পারো না? বলতে পারো না যাতে সংসারে অশান্তি
.
ওহে মহীয়সী মহিলা, হলে অবধান করুন। আমের মধ্যে যেমন আঁঠি, সংসারের মধ্যে তেমনি অশান্তি। মানে ওই অশান্তিটুকুকে অবলম্বন করেই সংসার নামক মাকাল ফলের গঠন। ওই অশান্তির আঁঠিটুকুকে আঁকড়ে ধরেই তার যা কিছু রং রস স্বাদ গন্ধ। অশান্তিকে বিতাড়ন করতে চাও তো আগে সংসারকে খণ্ড বিচ্ছিন্ন করো।
হয়েছে। খুব ব্যাখ্যা হয়েছে। সত্যি কী মুশকিল কাণ্ড বলো! আগে ভাবতাম, কান্তিবাবুর অমন দামি মেয়ে, তাকে কি আর ঠাকুরপোর হাতে দেবে? নিশ্চয় আসমান থেকে বর আসবে তার। শুধু মেয়েটার মতিগতিটুকুই ভরসাস্থল ছিল। আর এখন এ পক্ষই রিজেক্ট করতে চাইছে
ওই তো! ওই তো ভবের খেলা। এই তো দেখোনা, তোমার বাবা কত না সাধ্য-সাধনা করে আমা হেন জামাই জোগাড় করলেন। আর এখন? শ্বশুর ঠাকুরের সেই কন্যাকে সাধ্যসাধনা করতে করতেই আমার
তাই তো! খুব বক্তৃতা হয়েছে। তোমার দ্বারা যে কিছু হবে না সে আমার জানাই ছিল। যাক আমিই দেখি–
তুমি দেখতে গেলে ফল উলটো হওয়ার চান্সই শতকরা একশো দশ।
তার মানে?
মানে পরিষ্কার। যেখানে প্রেম, সেখানেই তোমার সহানুভূতি।
তাই নাকি? আমাকে তো তা হলে চিনেই ফেলেছ দেখছি।
না, একেবারে ফেলেছি তা বলতে পারি না, তবে কিছু কিঞ্চিৎ চেষ্টা করছি।
বউ হেসে চলে যায়।
.
তা সিদ্ধার্থও কথায় তার দাদার চেয়ে বেশি বই কম নয়। বউদিকে সে কথার ঘায়েই উড়িয়ে দেয়। সেও বলে, বলল কী বউদি, সংসারে যাতে অশান্তি না আসে তার সাধনা করতে লেগেছ তুমি? তাজ্জব!
কেন, আমি বুঝি তোমাদের সংসারে কেবল অশান্তিই সৃষ্টি করি?