কিন্তু বাবা
বলতে গিয়ে থেমে যায় সুমনা।
যা বলতে যায়, পারে না।
কান্তিকুমার মেয়ের ওই রুদ্ধ অভিমানে ভরা যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন, মনটা পীড়িত হয়, বিগলিত হয় না। না, কেউ যদি আপন দুর্মতিতে কষ্ট পায়, সে যতই স্নেহভাজন হোক, তার জন্যে মন গলে না। তাই স্থির স্বরে বলেন, বলো, কী বলতে চাও। থামবার দরকার নেই।
বাবা!
জলভরা দু চোখ বাবার মুখের দিকে তুলে সুমনাও স্থির স্বরে বলে, আমায় তোমরা ক্ষমা করো। আমাকে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিতে দাও। মাঝে মাঝে তোমাদের আদর করে উপহার দেওয়া টাকা তো অনেকগুলো জমেছে আমার, আর কতগুলো গয়নাও রয়েছে–
ধৈর্যের বাঁধ আর থাকে না।
কান্তিকুমার সংযত সভ্য মার্জিত। কান্তিকুমার পরিজনের কাউকে কখনও উঁচু কথাটি বলেন না। তবু কান্তিকুমার রক্তমাংসের মানুষ। তাই মেয়েকে কথা শেষ করতে দেন না। প্রচণ্ড একটা ধমকে থামিয়ে দেন তাকে। সেই ধমকের চেহারাটা এই, সুমনা, ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকে। আমি তোমার এই বিদঘুটে খেয়ালকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেব না। ভেবেছিলাম, বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরিয়ে আনতে পারব। দেখছি তা হচ্ছে না। ঠিক আছে, জোরই খাটাতে হবে। কালই তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে। আর একলাই যাবে।
সুমনা বোধ করি ধমক খেয়েই কঠিন হয়ে যায়। সেই জলভরা চোখ শুকিয়ে ওঠে মুহূর্তে। বলে, আর ও?
ওর যা উপযুক্ত ব্যবস্থা, আমি যে করে পারি করব।
সুমনা বাপকে আঘাত করবে বলেই কি আঘাত করে? না, এ তার অসতর্কতা? কিন্তু চোখের কোণে তার আগুন ঝলসে ওঠে, ওর পক্ষে যা সবচেয়ে উপযুক্ত সেটাই তো সব চেয়ে সোজা বাবা! তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের একটা ছুরি সুমনার অমন নরম গড়নের ঠোঁটের রেখায় উঁকি মারে, সেটাই বোধ করি ভেবে ঠিক করে রেখেছ?
কান্তিকুমার স্তব্ধ হয়ে যান।
ওই আগুন ছিটকানো চোখ, আর ওই ব্যঙ্গের ছুরি উঁচনো ঠোঁট, এ কি বুদ্ধিভ্রংশের? সুমনা পাগল হয়ে গেছে, এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেবার পথ আছে?
না।
মনকে সান্ত্বনা দেবার নেই।
তাই মনকে স্থির করে ফেলেন কান্তিকুমার। স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলেন,ঠিক আছে। একথা যখন বলতে পারলে তখন তোমার স্বেচ্ছাচারিতায় আর বাধা দেব না। যা কিছু ঘটতে থাকবে, অবশ্যম্ভাবী বলেই মেনে নেবার জন্যে মনকে প্রস্তুত করে নেব। একটু আগে পর্যন্তও মনে হচ্ছিল, তুমি আমাদের সম্পত্তি, তুমি আমাদের সেই ছোট্ট সুমনা। বুঝতে না পেরে একটা ভুল করতে চাইছ, তাই চেষ্টা করছিলাম বোঝাতে। নিজেই বুঝতে পারছিলাম না তুমি আস্ত একটা মানুষ। বুঝতে পেরেছি। আর ভুল হবে না।
স্ত্রীর কাছে এসে বলেন, ও যা করতে চাইছে করতে দাও। তারপর দেখা যাবে ভাগ্য কী বলে।
ও যা করতে চাচ্ছে তাই করতে দেব? সুজাতা ঝংকার দিয়ে ওঠে, জীবনভর মেয়ের যথেচ্ছাচার আর যাবতীয় আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে এইটি করে তুলেছ। আরও তিনটে ছেলেমেয়ে আছে তোমার, কই, তাদের তো এত আদর দাও না!
কান্তিকুমার এত দুঃখেও একটু হাসেন।
বলেন,ঠিক এই কথাটা আমিও তোমাকে বলতে পারতাম, কিন্তু বলব না। পুরুষ জাতটা যতই অত্যাচারী হোক, নিষ্ঠুর নয়। সুমনা আমাদের প্রথম সন্তান, আর অনেকদিন পর্যন্ত একটিমাত্রই সন্তান ছিল, সেই থাকার সুযোগ ও শুধু আমার কাছ থেকেই নয়, বাড়িসুষ্ঠু সকলের কাছ থেকেই পেয়েছে। সেই অতিরিক্ত পাওয়াটা যদি ওকে বিকৃত করে থাকে, জেদি করে তুলে থাকে, সকলকেই তার ফল ভোগ করতে হবে। কাল যাবার ব্যবস্থা করো।
ওই আঁস্তাকুড়টাকে নিয়েই?
হ্যাঁ!
কান্তিকুমারের ফেরবার কথা ছিল আরও কিছুদিন পরে। কিন্তু পরিস্থিতিটা এমন অদ্ভুত ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যা ভাবছিলেন তা হল না।
ভেবেছিলেন, এখান থেকে পালাতে পারলেই সুমনার মনকে ঠিক করে ফেলতে পারবেন। সহসা যাতে বিভ্রান্তি এসেছে সুমনার, সেটা থেকে সরে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু সুমনা সব ভেস্তে দিচ্ছে।
অতএব
কান্তিকুমার বলেন, আমার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে চলার পথে কোনওদিন তো ঠেক খাইনি, সুমসৃণ বাঁধা রাস্তায় জীবনের রথ চালিয়ে নিয়ে চলেছি, কোনওদিন পথ আড়াল করে দাঁড়ায়নি ভাগ্যের প্রতিকূলতা, দুঃখ দুশ্চিন্তার ঝড়। এখন যদি আসেই সে সব, সইতে হবে। রাগ করলে চলবে কেন? অসহিষ্ণু হলে চলবে কেন? জীবনের প্রাপ্য পাওনা বলে মেনে নিতে হবে।
অতএব
চলুক সুমনার সঙ্গে তার সাধের শৃঙ্খল।
অতএব কলকাতায় ছোট ভাইকে টেলিগ্রাম করে দিলেন কান্তিকুমার, আমাদের মেয়াদের আগেই ফিরে যাচ্ছি। হয়তো একরকম বাধ্য হয়েই। আমাদের সঙ্গে আরও একটি প্রাণী যাচ্ছে। তার জন্যে হয়তো সংসারে কিছু সংঘর্ষ উঠবে, কিন্তু উপায় নেই।
সুজাতা তবু হাল ছাড়ে না।
আবার আসে মেয়ের কাছে।
তার দুর্বলতার জায়গাটা নাড়া দেয়। বলে, তুই যে এম. এ. পড়বার জন্যে এত উৎসাহ করছিলি, জলাঞ্জলি দিবি তাতে?
সুমনা ফিকে হাসি হেসে বলে, বি, এর রেজাল্টই বেরোক আগে।
এটা অবশ্য উত্তর নয়, উত্তর এড়ানো। সুজাতা বলেন, রেজাল্ট বেরোবেই না, না পাস করবি না, কোনটা ভাবছিস?
কোনও কিছুই এখন ভাবছি না মা আমি। ভাবতে পারছি না।
তা পারবি কী করে?সুজাতা তীব্র স্বরে বলে, ভূতে আশ্রয় করলে কি আর চিন্তাশক্তি থাকে? ভূত যে সেইখানেই আশ্রয় করে। কিন্তু সুমি, আমি তোর মা, আমার কথা শোনা উচিত, এই ভেবেই শোন। বুদ্ধি একটু ঠিক করে, দৃষ্টিশক্তি একটু পরিষ্কার করে ভেবে দেখ, মেয়েমানুষ তুই, অকারণ যেচে একটা নিন্দে কলঙ্ক মাথায় তুলে নিবি কেন?