পিসিমা।
সেই তীব্র ইচ্ছার তীক্ষ্ণ প্রকাশটা আর চেষ্টা করে থামিয়ে রাখতে পারে না সুমনা। সে-ইচ্ছে ফেটে পড়ে, পিসিমা, দোহাই তোমাদের, আমার কথা তোমরা একটু কম ভেবো।
আর কারও সঙ্গে ঔদ্ধত্য করবে না ভেবেছিল।
সংকল্প বজায় রইল না।
পিসিমা চোখ ভুরু কুঁচকে চলে গেলেন।
সারাদিন আর কেউ সুমনার খোঁজ করল না।
বিকেল চারটেয় কান্তিকুমার এলেন। অঞ্জনাকে দিয়ে বলে পাঠালেন, দিদিকে ঠিক হয়ে নিতে বলো।
ঠিক হয়েই ছিল সুমনা।
বেরিয়ে এল।
সুজাতা ওর ঘরে গিয়ে বসেছে। ভারী ভারী মুখে বলেছে, কখন কী খাবে দেখিয়ে দিয়ে যাও। মাপটাপগুলো একটু বুঝিয়ে দাও।
বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে সুমনা।
আর তারপর? বাইরে বেরিয়ে সমস্ত বহিঃপ্রকৃতির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে দেখে নিজে বুঝতে পারছে না, কোথায় ছিল সে এতদিন?
সুমনা নামক জীবটা এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছিল না কি! কী জন্যে?
বাইরে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মন, ঘরটা ঝাপসা হয়ে আসে, নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।…
এম. এ. না পড়লে কী হয়! সবাই কি এম. এ. পাস করে? এ চিন্তাটা ধূসর হয়ে ওঠে।
সহপাঠিনী বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হয়। সুমনা নামে যে মেয়েটা বলতে গেলে ওদের মধ্যমণি ছিল, তাকে দেখে সবাই কলকাকলিতে উচ্ছল হয়ে ওঠে। পরস্পরের মার্কশিটের স্তর-বিভেদ নিয়ে আলোচনায় তৎপর হয়।
তোর আর ভাবনা কী?
এই প্রশ্নে মুখর হয়ে উঠেছে বান্ধবীরা।
তুই তো ফার্স্টক্লাস পেয়েছিস
ত্যি, কী করে পেলাম রে তাই ভাবছি। একেবারে আশা করিনি। যা ভুগেছি তখন।
আগের সুরে আগের মতো করেই কথা বলে সুমনা। বলতে পারে।
আশ্চর্য, এই হালকা সুরটা এখনও তবে আছে সুমনার স্বরযন্ত্রে?
আরে রেখে দে। তুই তো পরীক্ষা না দিলেও পাস করতিস।…যা একখানা মাথা!..
ওরা সুমনার সেই ভয়ংকর নির্বুদ্ধিতার খবর রাখে না।
তাই উচ্ছ্বসিত উল্লাসে সুমনার যা একখানা মাথার তারিফ করছে।
ওরা জানে না।
তাই সুমনা ওদের কাছে সহজ হতে পারছে–পুরনো মূর্তিতে ঝলসে উঠতে পারছে।
কান্তিকুমার মার্কশিট দেখে নেবার পর বিচলিত আনন্দে তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়িতে বসে আছেন।
আর ভাবছেন, আগে হলে, আগের সুমনা আর আগের সংসার থাকলে সুমনার এই কৃতিত্বের খবর নিয়ে বাড়ি ঢুকতেন কী উল্লাসের সমারোহ নিয়ে!
এখন তা হবে না।
এখন হয়তো সুমনা বাড়ি ঢুকবে পাথরের মতো!
কান্তিকুমার ঢুকবেন অপরাধীর মতো।
.
কয়েকটা মেয়ে হইহই করতে করতে এগিয়ে এল কান্তিকুমারের কাছে।
মুখপাত্র সোমা।
সিদ্ধার্থের ভাগ্নী।
কিছুটা চেনা বলে মুখপাত্র হয়েছে। সবাই ঘটাঘট প্রণাম করে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
সন্দেশ কই? সন্দেশ কই? সুমনার পাসের সন্দেশ।
ইস্ শুধু সন্দেশে ছাড়ব নাকি? রীতিমত ভোজ চাই।
ভোজ ছাড়াও আমাদের ব্যাচকে সিনেমা দেখাতে হবে। হ্যাঁ ছাড়ব না। শেষ দাবিটা সোমার।
কান্তিকুমার তাকিয়ে দেখেন।
কান্তিকুমার যেন অবাক হয়ে যান। জগতে এখনও এত আনন্দ আছে, আলো আছে।
আর সুমনার মুখে।
সেখানেও যে এই আলোর আভা।
এই আনন্দের জগৎ থেকে সুমনা স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছে। অন্ধকার সেলে বন্দি করে রেখেছে নিজেকে!
এদের আনন্দোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে কান্তিকুমার বলেন, সবাই তো পাস করেছ? পালা করে সন্দেশ খেতে খেতে সন্দেশে তো অরুচি হয়ে যাবে।
বাঃ আমরা বুঝি সুমনার মতো? আমরা তো এলেবেলে! সুমনার স্পেশাল কেস।
হবে হবে। আসবে সবাই একদিন।
এই উচ্ছ্বাসের মুখে কান্তিকুমার বণ্ডে সই করে বসেন, তোমাদের বন্ধু নেমন্তন্ন করছে তোমাদের। কবে খাবে বলো?
কী মজা! কী মজা!
হইচইয়ের মধ্যে কবেটা হারিয়ে যায়।
গাড়ি গাড়ি।
গাড়ির শোভাযাত্রা।
যাদের গাড়ি আছে তারা তো গাড়ি নিয়ে এসেইছে। যাদের গাড়ি নেই তারাও আজ বন্ধু আত্মীয় প্রতিবেশী কারও না কারও গাড়ি চড়ে এসেছে। আবার বাসে ট্রামে পায়ে হেঁটেও এসেছে কেউ কেউ।
গাড়ির মিছিল।
মেয়ের মিছিল।
সুমনা তাকিয়ে দেখে।
গাড়িতে ওঠে।
অবাক হয়ে ভাবে, আশ্চর্য! এই এত মেয়ে, কারও জীবনে তার মতো সমস্যা আসেনি।
অবাক হয়ে ভাবে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমি এদের মতো ছিলাম।
সোমাকে গাড়িতে তুলে নিতে চেয়েছিল।
সোমা বলেছে, না, এখন তো মামার বাড়ি যাচ্ছি না, আগে বাড়ি যাব। তারপর মামার বাড়ি! একেবারে মাকে নিয়ে।
সঙ্গে কে আছে?
ছোটমামা।
ছোটমামা!
সিদ্ধার্থ!
সিদ্ধার্থ এখানে ছিল।
দেখা হয়নি সুমনার সঙ্গে।
দেখা করেনি সিদ্ধার্থ। অভিমান!
সুমনা কি অভিমান ভেঙে নিজে যাবে?
প্রশ্নের উত্তর পেল না।
অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর হঠাৎ মনে পড়ল, সে কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় পাস করে বাবার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে, সারা পথ চুপ করে। ভাবল, পাস করে সিদ্ধার্থর সঙ্গে দেখা করলাম না। সিদ্ধার্থও না।
তাকিয়ে দেখল বাইরের দিকে।
তেমনিই তো আছে সব।
সেই গোধূলিবেলার সোনালি আলো, সেই বৃষ্টিহীন শ্রাবণ দিনের ঈষৎ আর্দ্র মিষ্টি বাতাস, সেই রাস্তা বাড়ি দোকান। শুধু সুমনা আর সেই নেই।
এতক্ষণ বন্ধুদের দলে থেকে ভুলে গিয়েছিল, এখন মনে পড়ল।
বাবা গাড়ি চালাচ্ছেন।
ঘাড়টা দেখা যাচ্ছে। ঘাড় আর পিঠ।
কিন্তু সেইটুকুতেই যেন ধরা পড়ে যাচ্ছে কান্তিকুমার ক্লান্ত। কান্তিকুমার আনন্দহীন।
বাবাকে ডেকে কিছু একটা বলবার জন্যে মনটা আকুল হয়ে উঠল। কিন্তু কী বলবে? আগের মতো কি আছে সুমনা? আগে ইন্টারমিডিয়েটের সময় কৌতুকচ্ছলে বলেছিল, বাড়ি গিয়ে বলব, ফেল করেছি। তুমি যেন ফাঁস করে দিও না বাবা।