কিছু না!
বলে দুহাত উলটে হতাশার ভঙ্গি করে সুমনা।
ঠাট্টা রাখো। সিধুবাবুর সঙ্গে তা হলে দেখা হয়নি?
না। চমৎকার! ওঁরা দুজন–এই এই…এই সর্বনাশ করেছে। ওরে বাবা!…
ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি তুলে নেয় সুমনা অলকের কোল থেকে। হেসে ফেলে বলে, বাবাঃ! এমন করে চেঁচালি তুই। যেন কী না কি রাজ্য রসাতলে গেল।
অলক ভিজে পাজামাটা হাত দিয়ে ধরে আড়ষ্ট হয়ে ঘর থেকে যেতে যেতে বলে, তার চাইতে কিছু কমও নয়। ধোবার বাড়ির পাজামাটা গেল।…ইস…ইচ্ছে করে মানুষ এই জীব পোষে?
সুমনা ছেলেটার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে করতে মৃদু হেসে বলে,ত্রিসংসারের লোক তো তাই করছে।
ছুটে আসে অজীন।
দাদা, তুমি না খেয়ে-টেয়ে এসে দিদির সঙ্গে গল্প করছ? জেঠিমা রাগ করছেন।
আরে ব্রাদার রাখো তোমার জেঠিমা। দেখছ আমার অবস্থা?
দেখতে পায় অজীন। হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
সুমনা তাকে ডাকে।
বলে, শোন। পিসিমা চলে গেছেন?
ও বাবা চলে গেছেন কি? এখন তো চারদিন এখানে থাকবেন।অজীন গলা নামিয়ে বলে, জানো দিদি, পিসিমা বলেছে, এই অচিনকুমারটাকে বোর্ডিঙে না হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে ছাড়বে সে।
সুমনা ভুরু কুঁচকে তাকায়।
মুহূর্তে কঠিন হয়ে ওঠে ক্ষণপূর্বের হালকা হয়ে যাওয়া মনটা।…অলকের সঙ্গে কথার মধ্যে যে প্রসঙ্গটি প্রাণের মধ্যে হঠাৎ অনেক ভাবের তোলপাড় তুলেছিল, আনন্দ, অনুতাপ, অভিমান, মন কেমন, সেই ভাবের ওঠাপড়া থেমে গেল, ভুরু কুঁচকে কঠিন হয়ে বসে রইল।
বসে রইল যুদ্ধের বর্ম গায়ে এঁটে।
সিদ্ধার্থের কথা ভাবতে ভুলে।
অথচ আগে দিনান্তে সিদ্ধার্থের সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি, এমন দিন ওদের খুব কমই হত।
সিদ্ধার্থ পাড়ার ছেলে।
সিদ্ধার্থ অলকের বন্ধু।
সিদ্ধার্থ তিলে তিলে সুমনারও বন্ধু হয়ে উঠেছিল।
চেঞ্জে যাবার আগে দেখা করতে গিয়েছিল সুমনা। গিয়েছিল সেই ওদের নির্দিষ্ট প্রিয় জায়গাটিতে। হ্যাঁ, দেখা করার একটা জায়গা ওদের নির্বাচন করা ছিল। আর দেখা করার দায়টা সুমনা সর্বদা নিজের ঘাড়েই রেখেছিল।
বাড়িতে কথা কওয়া শক্ত।
বাড়িতে কত লোক, কত চোখ, কত মন্তব্য।
দুমাসের জন্যে যাচ্ছে শুনে সিদ্ধার্থ বলে উঠেছিল, দুমাস! অসম্ভব। আমাকেও তা হলে চেঞ্জে যেতে হবে।
ওখানেই বোধহয়?
তবে না তো কী?
হ্যাঁ দেখব কত দৌড়। চলে গেলেই নিশ্চিন্দি হবে।
ধারণাটা উচ্চাঙ্গের। কিন্তু চিঠি এক-আধটা লিখলে এমনই বা কী দোষ ছিল? একেবারে কড়া নিষেধের
না না সেই ভাল।
ভাল?
হুঁ।
বেশ। তবে ধরো যদি শুধু পোসটোকাটেদু-এক ছত্র–সুমনা, আশা করি তোমার ওখানে গিয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে অথবা সুমনা, তোমাদের রেজাল্ট বেরোবার আর বিলম্ব নেই–
আহা, তাতে লাভ?
লাভ অনেক। সে বোঝবার ক্ষমতা থাকলে তো।
না না থাক। দেখাই যাক না।
কী দেখা যাক না?
সুমনা মৃদু হেসে বলেছিল, বহর।
কিন্তু সুমনা নিজেই দেখাল শেষ পর্যন্ত।
সুমনা এ কী করেছে! ছি ছি!
সুমনার চিন্তায় ছেদ পড়ল।
পিসিমা ঘরে এলেন।
বেশ হইহই করতে করতে।
কই গো কানাইয়ের মা, তোমার কানাই দেখি।
সুমনা উঠে গিয়ে প্রণাম করল।
পিসিমা থাক থাক বলে একটি আশীর্বাদ সহযোগে বললেন, এসে তো শুনে অবাক। সবাই বলে, সুমি আমাদের না বিইয়ে কানাইয়ের মা হয়ে বসে আছে। হ্যাঁ রে তা লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে একটা ছানা নিয়ে এমন উন্মাদ হয়ে বসে আছিস কেন?
উন্মাদই হয়ে গেছি যে পিসিমা। এত খবর জানলে, আর সুমি পাগল হয়ে গেছে, এ খবরটুকু জানলে না?
ওমা! তোর কথাবার্তাও তো আর আগের মতন নেই দেখচি। ওরা তো ঠিকই বলেছে। পিসিমা গম্ভীর মুখে বলেন, ছোটবউ বলল, সরল মনে ছেলে নিতে গেলাম, নিতে দিলে না। ওর ধারণা ছেলেকে আমরা মেরে ফেলব।
তা ধারণাটায় আশ্চয্যি কি পিসিমা? যাকে নিয়ে সারা সংসারে অশান্তি
পিসিমা সহসা হৃদ্যতায় গলে গিয়ে বলেন,তা সেই কথাই তো বলছি বাছা। সংসারসুদ্ধ লোককে অশান্তি কেন দিচ্ছিস মা? কত লক্ষ্মী মেয়ে তুই, কত মায়া তোর শরীরে—
পিসিমা! ওই–ওইটাই সমস্যার মূল। মায়া জিনিসটার এমন দোষ, সে পাত্রপাত্র বাছতে ভুলে যায়।
হু! বুঝেছি। বাচ্চাটার ওপর মায়া পড়ে গেছে তাই বলছিস! তা অবিশ্যি পড়তেই পারে। পিসিমা আরও বিগলিত হয়ে বলেন, একটা পাখি পুষলেও মানুষের মায়া পড়ে, তা এ তো রক্তমাংসের জীব। তবে তোরা এত লেখাপড়া জানা, তোদের আর কী শেখাব, অপাত্রে মায়াটা তো কোনও কাজের কথা নয়! আজ বাদে কাল বাবা বিয়ের চেষ্টা করবে, তখন এই ছেলের কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে? হয়তো কত জনে কত অকথা কুকথা ভাববে–
সুমনার মুখের রেখা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। গলার শির নড়ে ওঠে ভয়ানক একটা কিছু বলবার তীব্র ইচ্ছায়। ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে পিসিমার এই ছদ্ম মমতার আবরণ। কিন্তু সংযত করে নেয় নিজেকে।
চুপ করে থাকে। চেষ্টা করে চুপ করে থাকে।
পিসিমার চোখে এই চেষ্টাটা ধরা পড়ে না।
তাই তিনি ওষুধে কাজ হচ্ছে ভেবে বলতে থাকেন, তার থেকে বলি শোন। খুব ভাল পরামর্শ, আমার বাড়ির ঘর ঝাড়া-মোছার ঝিটা দেখেছিস তো? নাম গৌরী। ভদ্রঘরের মতো চেহারা। স্বামী আছে, শাশুড়ি আছে। সে মাগী একটা ছেলে-ছেলে করে পাগল! কত মাদুলি কবচ পরে, কত ওষুধ পালা খায়, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এখন বলে একটা পথে কুড়োনো ছেলেও পাই তো পালি। ছেলেটাকে আমি নিয়ে গিয়ে তাকে পালতে দিই। কী বলিস? বরং ইচ্ছে হলে কিছু কিছু করে মাসোহারাও দিতে পারিস।…আর চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে।