কিন্তু ছোটখুড়ির সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহারের কোনও কারণ ছিল কী? ছোটখুড়ি তো ওদের বিপক্ষে। সুমনারই পক্ষে।
অর্থাৎ ওইটাই স্বধর্ম মালবিকার। প্রত্যেকে যা বলে, ও তার উলটো বলে। প্রত্যেকে যে ব্যাপারের বিপক্ষে রায় দেয়, ওর রায় সব সময় তার স্বপক্ষে। একবার একটা ঝি বাসন চুরি করে ধরা পড়েছিল। বাড়িসুষ্ঠু সকলে তাকে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করে তাড়িয়েছিল, মালবিকা সে চলে যাবার মুখে তাকে ঘরে ডেকে দশটা টাকা বকশিশ দিয়ে বলেছিল,অনেক লাঞ্ছনা খেয়েছিস। নে সন্দেশ খা।
কাজেই মালবিকা যে সুমনাকেই সমর্থন করবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু মালবিকার সঙ্গেও নম্রতা করেনি সুমনা। সুমনা ধৈর্য হারিয়েছিল।
মালবিকা যখন ঘরে এসে বলেছিল, কই দেখি যশোদার গোপালকে!
তখন সুমনা ছেলে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল। মালবিকা বুঝতে পারেনি, কোলে করতে গিয়েছিল, সুমনা প্রায় হাত থেকে কেড়ে টেনে নিয়েছিল। বলেছিল, থাক ছোট খুড়িমা, বকুনি বরং সহ্য হয়ে যাচ্ছে, ব্যঙ্গটা হজম করতে পারব না।
মালবিকা বলেছিল,আমি তোকে ব্যঙ্গ করতে আসিনি সুমি! ভাল ভেবেই এসেছি।
সুমি বলেছিল,বিশ্বাস করা শক্ত ছোটখুড়িমা।
আহত হয়ে চলে গিয়েছিল খুড়ি।
তারপর রাগ আর বিরক্তি, অপছন্দ আর আক্রোশ ধোঁয়াতে ধোঁয়াতে আগুন দেখা দিয়েছে, সুমনাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে মালবিকাও।
জেঠি সকলকে চুপি চুপি বলে বেড়াচ্ছেন, মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখো। রঙের সঙ্গে রং।
আশ্চর্য!
আশ্চর্য!
তবু দাদার কণ্ঠস্বরে বুকটা আশায় ভরে উঠতে চাইছে সুমনার।
মনে হচ্ছে দাদা ওদের মতো নয়।
এক হিসেবে সত্যিই নয়।
অন্তত তার মা-বাপের মতো তো নয়ই। মা-বাপের সম্পূর্ণ বিপরীত সে।
সস্ত্রীক শান্তিকুমার যেমন আচারনিষ্ঠ, দেবদ্বিজপরায়ণ, ধর্মে মতি ভক্তিবিগলিত, তাঁদের পুত্র অলক তেমনই ম্লেচ্ছচারী, দেবদ্বিজে মতিহীন, বেপরোয়া!
মা একটু চরণামৃত খাওয়াতে এলে বলে,দোহাই মা, ওই এক কোটি কলেরার বীজাণু হজম করি, এত গুরুবল আমার নেই।
গুরুদেব এলে বাপ যদি বলেন, এই যে বাবা এইটি আমার ছেলে। এই পড়ছে–অলক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাপের শত ইশারাতেও মাথা নোয়ায় না।
স্ফূর্তিবাজ বেপরোয়া।
এম. এ. পরীক্ষার আগের দিন গানের জলসায় সারারাত কাটিয়ে সকালে ফিরে বিছানায় লম্বা হয়ে বলে,আমায় ঠিক নটার সময় উঠিয়ে দিও তোমরা।
দাদা সুমনার প্রাণতুল্য।
সেই দাদাকে কতদিন দেখেনি সুমনা, সেই দাদার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে, তবু লাফিয়ে গিয়ে বলছে না–দাদা!
সুমনা সত্যিই তা হলে ভয়ানক একটা কিছু বদলে গেছে! সুমনা আর আগের সুমনা নেই।
আচ্ছা, ভূতে পাওয়া কথাটা কি সত্যি!
.
সুমনা গেল না।
দাদা এল।
লাফাতে লাফাতেই এল।
কী রে মনা, কী ব্যাপার!কী একখানা কাণ্ড পাকিয়ে বসেছিস? হাওড়া স্টেশন থেকে তো শুধু তোর গুণগরিমা শুনতে শুনতেই এলাম।
সুমনার চোখে কেন জল উপচে ওঠে?
অনেকদিন পরে স্বাভাবিক কথা শুনে? ফিকে একটু হেসে, সেই জলটাকে চাপা দেয় সুমনা।
তারপর বল তো শুনি প্রকৃত ঘটনা। জুত করে বসে অলক। খাটের ধারেই বসে। সুমনার অচিনকুমারের দিকে চোখ পড়ে যায়। ভোলা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে,আরে এ যে দেখছি ঘটনা সত্য! অ্যাঁ, এই সেই ফাঁসির আসামি! এর বিরুদ্ধেই এত ষড়যন্ত্র। ঠাকুমাতে, পিসিমাতে আর আমার মাতৃদেবীতে তো এখন গোল টেবিল বৈঠক বসে গেছে। পরামর্শপ্রার্থিনী জননী ও পিতামহী, পরামর্শদায়িনী পিতৃস্বসা। তা বেড়ে দেখতে তো! কাদের মাল বাবা! ছেলেটার গালে একটু টোকা দেয়, অল্প নিচু হয়ে ওর নাকে নাকটা ঠেকায়, তারপর বলে, তা হলটা কী?
হলটা কী, সে কথা কি বিশদ বলতে পারে সুমনা? সে ক্ষমতা কি ওর আছে? তাই মৃদু হেসে বলে, হাওড়া স্টেশন থেকেই তো শুনতে শুনতে আসছিস দাদা!
তা আসছি বটে! শুনে শুনে মোহিতও হয়েছি। শুনছি তোকে নাকি বেহ্মদত্যিতে পেয়েছে। তুই নাকি গুরু লঘু জ্ঞান করছিস না। হিতাহিতের মাথা খেয়ে বসে আছিস। বলেছিস নাকি রেজাল্ট দেখতে যেতে তোর দায় পড়েছে, এম. এ. নাকি শুধু পাগলেরা পড়ে।
সুমনা অনেকদিন পরে হেসে ওঠে।
হেসে ওঠে, বোধ করি খানিকটা বেঁচে ওঠে। যেমন বেঁচে ওঠে বোশেখ-জষ্টির রোদে নেতিয়ে থাকা কচি গাছ, প্রথম বর্ষার জল পেয়ে।
হেসে উঠে বলে, তবে তো প্রকৃত সত্য সবই জেনে ফেলেছিস।
হ্যাঁ, সত্যটা জানা হয়ে গেছে, এখন শুধু তত্ত্বটা জানতে বাকি! সিদ্ধার্থ আসে?
সুমনা মাথা নাড়ে।
হু! আমিও ওইরকম একটা কিছু অনুমান করছিলাম। তা সে হতভাগার আবার কী হল? তোর তো বেহ্মদত্যি, তার কি ব্ৰহ্মজ্ঞান? তাই আর এইসব ঐহিকের তুচ্ছতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না? খোঁজ করিসনি তুই?
নাঃ!
নাঃ! নাঃ মানে?
মানে কিছু নেই। এমনি।
ছেলেটাকে তুলে নিয়ে হাঁটুতে বসিয়ে নাচাতে নাচাতে বলে অলক, নমস্কার বাবা, তোমাদের ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার; সংসারে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে জানলে আমি সেই প্রভু জগড়নাথের চরণে লীন হয়ে পড়ে থাকতাম।
তোমার কী? সুমনা হাসে, তোমার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?
সম্পর্ক কী! চমৎকার! তুমি আমার বোন, এটা মানো তো?
একটু একটু।
যাক, ওই একটু একটু হলেই চলবে। যাক, আমি তার অর্থাৎ সে আমার বন্ধু, এটাও মানতে হয়। এই বোন আর বন্ধু এই দুটো বস্তুকে একত্রে মিশিয়ে মিক্সচার করে ফেলবার বাসনা আমার নেই বাল্যাবধি। আজ যদি সে বাসনায় ছাই পড়ে, দুজনের একজন যদি ব্রহ্মে আর অপরজন যদি ব্ৰহ্মদত্যিতে লীন হয়ে যায়, করবার আর রইল কী!