যাদের স্বার্থে এতটুকু আঁচড় লাগবে না, তারাও এসে কুটিল দৃষ্টিতে তাকায়।
না, এখন আর কেউ আসছে না, কিন্তু প্রথম প্রথম সবাই এসেছে এ-ঘরে। মেলার বাজারে পাঁচপেয়ে গোরু দেখতে যেমন আসে, তেমনই এসেছে খোকা কোলে সুমনাকে দেখতে।
সুমনা তাদের সঙ্গে উদ্ধত হয়ে কথা বলেছে। সে খবর পেয়েছেন কান্তিকুমার। কিন্তু খবর পেয়েছেন কি কীভাবে তারা কথা বলেছে?
কতটা ব্যঙ্গরসাশ্রিত।
কতটা ঘৃণা আর ধিক্কার মিশ্রিত!
ঠাকুমা!
যে ঠাকুমার চক্ষের নিধি সুমনা।
সুমনার যাত্রাকালে যিনি বাহান্ন দেবতার নির্মাল্য আর চরণামৃত এনে হাজির করেছিলেন, আর চোখের জল মুছে-মুছে আঁচলের কোণটা ভিজিয়েই ফেলেছিলেন।
সেই ঠাকুমা এসে গাল হাত দিয়ে ছি ছি করে উঠলেন, হ্যাঁ রে মনা, এই তোর বিদ্যেবুদ্ধি, এই তোর রুচি প্রবৃত্তি! রাস্তায় ফেলে দেওয়া জঞ্জাল কুড়িয়ে এনেছিস তুই! তোর বাবা অনাথ আশ্রমে দিতে চেয়েছিল, দিসনি!
তখনও মানুষের ওপর একটু আশা রাখত সুমনা। তখনও জানত না মানুষ সত্যি কত ক্ষুদ্র, কত দীনচিত্ত!
তাই সেই ফুলের মতো ছেলেটাকে দু হাত বিছিয়ে ধরে ঠাকুমার সামনে বাড়িয়ে বলেছিল, আচ্ছা দিদা, তাকিয়ে একবার দেখো তো, ডাস্টবিনের জঞ্জাল বলে মনে হচ্ছে?
ঠাকুমা সাত পা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। হাঁ হাঁ করে বলে উঠেছিলেন, হচ্ছিল আর একটু হলে। এই অবেলায় নেয়ে মরতে হত।
নেয়ে মরতে তুমি একে ছুঁলে?
তা আমার এখনও পুজো পাঠ ছিষ্টি বাকি। না নাইলে? তোমার ওই সোনার কার্তিকটি কীসের ছেলে তা তো আর
হ্যাঁ, উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।
বলেছিল, দিদা, খুব তো বড় বড় কথার বড়াই করো। খুব তত ভাগবত আর চৈতন্যচরিতের পাঠ শুনে এসে জীবে দয়ার গুণকীর্তন করো, ভেতরে ভেতরে মন এত ঘোট কেন?
ঠাকুমা রেগে উঠে বলেছিলেন, তা তোর মতন এত উঁচু মন যদি ভগবান না দিয়ে থাকে? বলি আইবুড়ো মেয়ে তুই, তোর এত ফড়ফড়ানি কেন রে? লোকলজ্জা নেই? ছেলে ছেলেকরে আদিখ্যেতা করলে লোকে বলবে কী?
দিদা! সংসারে যদি একটা মা-মরা ছেলে থাকত, তাকে মানুষ করলে আইবুড়ো মেয়ের নিন্দে হয়?
শোনো কথা! তাতে আর এতে! এর মা কি মরেছে? কে জানে কোন চুলোখাকি—
দিদা! এর কাছে তো এর মা মৃতই।
ঠাকুমা বিরক্তকণ্ঠে বলেছিলেন,অত কথা জানি নে মনা, ওসব অশুদ্ধ ছেলে ঘরে থাকলে সকলের সঙ্গে ছোঁয়া নাড়া হবে না? আর তুই ওর ঝি-গিরি করলে তোর হাতেই বা কে জল খাবে?
উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।
বলেছিল, আমি কাউকে হাতের জল খাওয়াতে যাবও না দিদা। আর কেউ না খেলে দুঃখে মরেও যাব না। তবে তোমাদের ধর্ম পুণ্যি গীতা ভাগবত সব মর্ম জানা হয়ে গেছে আমার। তাই ভয়ও নেই।
.
এসেছিলেন জেঠি।
সকালবেলা স্নানের আগে।
ডিঙি মেরে ঘরের মধ্যে একটু পা বাড়িয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ রে সুমি, ঠাকুমাকে নাকি যাচ্ছেতাই করেছিস?
সুমনা উদ্ধত হয়েছিল।
কারণ, সুমনা তখন মানুষের ওপর থেকে আশা সরিয়ে নিচ্ছিল।
তাই বলেছিল, হ্যাঁ করেছি।
ওমা শোনো কথা। হ্যাঁ লা সুমি, তুই তো আগে এমন ছিলি না।
আজকাল ওইরকমই হয়েছি জেঠিমা। ভূতে পেয়েছে কিনা।
দেখ সুমি, তোর ঘরে আমি পা ধুতেও আসতাম না, এসেছি নেহাত দুটো সৎ উপদেশ দিতেই। তা অপমানটা করলি ভাল। তবে বলি, এ বাড়িতে তোর ওই ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা চলতে থাকলে আমাদের দু প্রাণীকে বাধ্য হয়েই আশ্রমে গিয়ে থাকতে হবে।
সুমনা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল।
বলেছিল,আহা! জেঠিমা, আমাকে তা হলে একদিন সন্দেশ খাইয়ে দিও। আমিই যখন তোমার উচ্চমার্গের পথপ্রদর্শক।
অতটা অহংকার ভাল নয় সুমি—
বলেছিলেন জেঠিমা।
যে জেঠিমা বাড়িতে কেউ এলেই শতমুখে সুখ্যাতি করতে বসতেন সুমনার। বলতেন, এমন গুণের মেয়ে এ-যুগে জন্মায় না। বলতেন,এত রূপ, এত গানের গলা, বাপের কত পয়সা, বছর বছর ক্লাসে ফাস্ট, অথচ এতটুকু চাল অহংকার নেই। মেয়ে তো নয়, সোনার মেয়ে।
সেই জেঠিমা বললেন, অত অহংকার ভাল নয় সুমি।
বলেছিলেন, বাপের পয়সায় ধরাকে সরা দেখছিস, মনে জানিস রাজপুত্তুর এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে, যাকে যা ইচ্ছে বলে নিতে পারি। কিন্তু ওই ছেলে পালতে বসলে বিয়ে হবে না, তা মনে রাখিস।
মনে রাখব।
বলেছিল সুমনা।
চলে গিয়েছিলেন জেঠি।
এসেছিলেন জেঠা।
অনেক জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, এখন আমার কথা তেতো লাগবে। কিন্তু দেখো পরে বলতে হবে, হ্যাঁ বলেছিল বটে জেঠামশাই।
উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।
বিনয়ের ছদ্মবেশে যতটা ঔদ্ধত্য সম্ভব। বলেছিল, আপনার উপদেশ আমার মনে থাকবে জেঠামশাই।
পর পর তাসের মতো সাজিয়ে দেখছে সুমনা।
এসেছিলেন কাকা।
যাচ্ছেতাই গালাগাল করতে করতেই ঢুকেছিলেন। সুমনাকে নয়, সুমনার মা বাপকে।
আর বলেছিলেন, একান্নবর্তী পরিবারে কারও যা খুশি করবার স্বাধীনতা নেই। হতে পারেন মেজবাবু হাইকোর্টের উকিল, কিন্তু ছোটবাবু আইনের সাহায্য নিয়ে এই স্বেচ্ছাচার অনাচার বন্ধ করে দিতে পারেন। মেজবাবুকে বাধ্য করতে পারেন ওই ছেলেটাকে অনাথ আশ্রমে পাঠাতে।
মানুষের ওপর আশা আর তখন ছিল না সুমনার, তাই উদ্ধত হয়েছিল। বলেছিল, সেই চেষ্টাটাই বরং করা গে ছোটকাকা। তবু কিছু পরকালের কাজ হবে।
বাঘিনীর মতো দরজা পাহারা দিয়ে কথা বলেছিল ওদের সঙ্গে। পাছে কারও নজর লাগে।