সুমনা কী উত্তর দিত কে জানে!
ঠিক এই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল ছেলেটা।
পরিত্রাহি কান্না।
যে কান্নাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির লোকের কান আড়াল করে রাখবার চেষ্টা করে সুমনা।
কান্তিকুমার উঠে দাঁড়ান।
বলেন, তা হলে তোমার আর রেজাল্টের জন্যে যাবার সুবিধে হচ্ছে না?
সেই কান্নার দরজায় একটা হাত চাপা দিয়ে রেখে সুমনা বলে, না, যাব।
আচ্ছা!
বাবা!
কান্তিকুমার চলে যাচ্ছেন।
সুমনার ডাকটা পিছনে আছড়ে পড়ে।
ফিরে তাকান কান্তিকুমার।
তাকান প্রত্যাশার পাত্র হাতে। ভাবেন, হয়তো এই মুহূর্তে বলে উঠবে সুমনা, বাবা তুমি যা ভাল বোঝ করো।
কিন্তু না।
তা বলে না সুমনা। শুধু বলে, তুমি মাকে বোলো তখন এ-ঘরে একটু থাকতে।
ছেলেটাকে কোলে করে ভোলাতে ভোলাতেই বলছে সুমনা।
কান্তিকুমার একটু চুপ করে থেকে বলেন,বেশ। বলে দিচ্ছি। তোমার মার কাছে এটুকু বলার সাহসও তোমার হচ্ছে না, এটা অভিনব। তোমার এই কুণ্ঠাই অনেকের অনেক সন্দেহের উপকরণ জোগাচ্ছে। যাক সে কথা। কিন্তু সুমনা, ওই বাচ্চাটাকে কতদিন তুমি ঘরে আগলে রাখতে পারবে? ও তো ঘর থেকে বেরোবে। শিশুর স্বধর্ম যা, তা পালন করবে। তখন?
আমি পরের কথা কিছু ভাবতে পারছি না বাবা।
না ভাবাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বলি শোনো–আমি ওর জন্যে আয়া রেখে দেব। তুমি এম. এ. পড়বে।
কান্তিকুমার বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
.
একটু পরে অনড় সুমনার কানে একটা হইচই শব্দ এসে পৌঁছয়। কে যেন এসেছে। কে এসেছে? পিসিমা। পিসিমা এলে তো দাদাও আসবে। যার আশায় দিন গুনছে সুমনা। এখনও যার ওপর একটু আশা রেখেছে। প্রতিদিন যার কথা মনে পড়েছে, একজন কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছে দাদা কবে আসবে, দাদা যেখানে গেছে তার ঠিকানা কী। পারেনি জিজ্ঞেস করতে।
হ্যাঁ পিসিমাই।
এসে পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।
পুরী গিয়েছিলেন রথের রশি টানতে। থেকে গিয়েছিলেন তারপর মাস দেড়েক। তাঁর সঙ্গেই অলক গিয়েছিল।
দাদা? দাদা কোথায় রে? এসেই জিজ্ঞেস করেছিল সুমনা, কোনও একটা ছোট ছেলেকে।
শুনেছিল দাদা পিসিমার কাছে পুরী গেছে।
দাদা! জেঠিমার একমাত্র ছেলে। একান্নবর্তী পরিবারে জেঠতুতো খুড়তুতোর বিভেদ ছোটদের হৃদয়ে বিষগাছ রোপণ করে না। নিজের দাদা থাকলে সুমনা এই জেঠতুতো দাদার চাইতে কিছু বেশি ভালবাসত, এমন ধারণা তার অন্তত নেই।
তাই পিসিমার গলার শব্দে আশায় উদ্বেল হয়ে ওঠে সুমনা।
তবে দাদাও এসেছে।
কিন্তু
যদি দাদাও!
হ্যাঁ, যদি দাদাও ওদের মতো হয়ে যায়। যদি মুখটা কালো করে ঘরের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করে, ঘরের মধ্যে না তাকায়! যদি দাদাও ভাবে, ওই কুড়িয়ে পাওয়ার গল্পটা একটা বানানো গল্প মাত্র।
বেরোতে গিয়ে থেমে যায় সুমনা।
ফিরে আসে দরজার কাছ থেকে।
ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলে,আসুক আসুক, আরও ঝড় আসুক। দেখব আমার শক্তি।
দাদার গলার শব্দও ভেসে আসছে। ওর স্বভাবগত উচ্ছ্বাসে ঠাকুমার সঙ্গে কথা চালাচ্ছে। দাদার এই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠের ধ্বনির তরঙ্গে যেন ভেসে আসছে আরও একটা কণ্ঠধ্বনি।… বাইরে নয়, মনে।
আশ্চর্য!
কলকাতায় ফিরে আসার এই এতদিন পরে মনে পড়ল তাকে সুমনার। কান্তিকুমারের কথাই তা হলে ঠিক? সুমনাকে ভূতে পেয়েছে?
তাই সুমনা জামাকাঁথা ভিজে বিছানা ফিডিংবটল আর হাসি কান্নার মধ্যেই একেবারে সমাধিস্থ হয়ে গেছে।
সত্যিকার মা, নতুন মা, অনেক তো দেখেছে সুমনা, কই এমন অবস্থা তো হয় না তাদের। সারাক্ষণ শুধু চোখ পেতে বসে থাকতে তো দেখে না। বরং বাপরে মারেই করে কত সময়।
সুমনার হৃদয়েই কি মাতৃস্নেহ এত প্রবল যে, সমস্ত পৃথিবী বিস্মৃত করে দিচ্ছে সেই স্নেহপ্লাবন। অথচ যে মাতৃস্নেহ কৌতুককর!
সুমনা ভাবে, সত্যিকার মাদের কি সর্বদা এমন হারাই হারাই ভয় হয়? তাদের কি এককণা একটা প্রাণকে সারাক্ষণ পৃথিবীর অকরুণ আর হিংস্র দৃষ্টির আওতা থেকে রক্ষা করে ফিরতে হয়?
সুমনার মতো দুর্ভাগ্য কার?
কান্তিকুমার বলে গেলেন সুমনা গুরুজনের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার করেছে। অন্যায় সুমনার, ঘোরতর অন্যায়। কিন্তু গুরুজন যদি গুরুত্ব হারায়? তারা যদি স্নেহ সহানুভূতির কোঠা থেকে নেমে এসে মজা দেখার কোঠায় দাঁড়ায়?
সুমনা কী করেছে?
কী এমন গর্হিত কাজ।
একটা জীবন, হয়তো সেই মুহূর্তে বিনষ্ট হয়ে যেত, তাকে রক্ষা করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই তার অপরাধ।
কিন্তু কেউ তাকে বলেনি সত্যিই তো ঠিক করেছ।
অবশ্য তারপর কান্তিকুমার যা ব্যবস্থা করেছিলেন, হয়তো সেইটাই মেনে নেওয়া উচিত ছিল সুমনার।
পারেনি সুমনা।
কচি কোমল মাতৃদেহ স্পর্শাকাঙ্ক্ষী শিশু দেহখানি বুকে চেপে ধরে সুমনা। মনে মনে বলে, না পারিনি।
মনে হয়েছে ও যেন ওর ওই কাঁচের মতো চোখ দুটি তুলে সুমনার কাছে আশ্রয় চেয়েছে।
কিন্তু সুমনাকে কেউ সুবিচার করল না।
সুমনার প্রকৃতি কারও মনে পড়ল না।
মনে পড়ল না অনেকদিন আগে একটা পথ থেকে কুড়নো ঘেয়ো কুকুরছানাকে এমনই বুক দিয়ে আগলে থেকেছিল সুমনা। শত তিরস্কারেও ত্যাগ করেনি তাকে।
তারপর তো সে নিজেই মুক্তি দিয়ে গেল সুমনাকে।
একে নিয়ে তাই না এত উৎকণ্ঠা সুমনার। এতগুলো কুটির বিষ হজম করে ও কি বাঁচবে?
ভ্রূকুটি।
সবাইয়ের ভ্রূকুটি।