ছেলেটা বালক।
তার উপযুক্ত উত্তরটা নয়।
তবু উত্তরে বলেছিল সুমনা, তা হোক, তা হলেই ভাল হত। পৃথিবীতে তো অনেক মানুষ-নেকড়ে আছে, দু-একটা নেকড়ে-মানুষ থাকলই বা!
অজীন বলে ওঠে, বাঃ তুমি তা হলে কী পুষতে?
সুমনা চমৎকৃত হয়ে বলে, আমি এটা পুষছি, একথা তোকে কে বললে রে অজি?
অজীন বলে ওঠে, বাঃ, ঠাকুমা বলেছিল না বুঝি বাবাকে?
বলেছিল! কী বলেছিল?
বলেছিল, হ্যাঁ রে কান্তি, তোর মেয়ে তা হলে ওই রাস্তা থেকে একটা ছেলে কুড়িয়ে এনে পুষবে!
বাবা বললে, হ্যাঁ, এতকাল কুকুর বেড়ালের ছানা কুড়িয়ে এনে পুষেছে, এইবার মানুষের ছানা এনেছে। তা ঠাকুমা বলল কী, বিদেয় করে দে। বিদেয় করে দে। কুকুরছানা পুষলে তো আর খাজনা লাগে না। মানুষের ছানা পুষতে যে খাজনা লাগে।–হ্যাঁ দিদি, সত্যি?
সত্যি বইকী অজু! ঠাকুমা কি আর ভুল বলেছেন?
মনে মনে বলে, ভুল? বোধ করি এর চাইতে বড় সত্য আর নেই, কিন্তু সুমনা একবার দেখবে কত অঙ্ক সেই খাজনার।
অজীন ততক্ষণে অন্য প্রসঙ্গে এসে পড়েছে।
দিদি, এর নাম কী?
নাম!
সুমনা ভাবে, কই, এর তো কোনও নাম ঠিক হয়নি এখনও! সুমনা মনে মনে, নিতান্ত নিভৃতে কত অজস্র নামে ডাকে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সেই বিশেষণ কোথায়, যা দিয়ে তাকে বিশ্বসংসারে অভিহিত করা যাবে?
দরকার পড়েনি।
ওর সম্পর্কে কারও কোনও কথা তো হয় না। তর্কের সময়, উপদেশের সময়, সকলেই বলে ওটা, ও!
সুমনা হেসে বলে, ওর মা বাপ তো ওকে নাম দেয়নি, তুই দে না একটা নাম।
আমি?
মহোৎসাহে প্রায় ফুটখানেক উঁচু হয়ে ওঠে অজীন, আমার নাম তুমি নেবে?
ওমা কেন নেব না? তুই বেশ ভাল দেখে–
আচ্ছা দাঁড়াও, রোসো রোসো, আমি ওর নাম দিলাম অচিনকুমার।
সুমনা বিস্মিতকণ্ঠে বলে,ওরে বাবা, এত সুন্দর নাম, তুই কোথায় পেলি রে? আগে ভেবে রেখেছিলি বুঝি?
কক্ষনো না! আমি তো এইমাত্তর বানালাম।
সত্যি!
সত্যি সত্যি সত্যি। এই তিন সত্যি। আমি তো ওর মামা হই, তাই আমি ভাবলাম আমি অজীনকুমার, ও অচিনকুমার।
সুমনা নিষ্পলকে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,তুই ওর মামা হোস, একথা কে বললে?
বাঃ বলবে আবার কে! আমার বুঝি বুদ্ধি নেই? আমি তো তোমার ভাই হই। তোমার পোষা ছেলের আমি মামা হব না তা হলে?
সুমনা শান্তহাসি হেসে বলে, তা হলে শুধু মামা নয়, পোষা মামা!
পোষা মামা? তাই বলে ডাকবে ও আমাকে?
ডাকতেও পারে। যদি জগতের লোক ওকে কথা বলতে দেয়।
বলতে দেবে? কী করে বলতে দেবে?অজীন একটু ধাঁধায় পড়ে বলে,ও তো এতটুকু, ও কি কথা বলতে পারে? আগে কথা বলতে শিখুক।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো সত্যি!
সুমনা মনে মনে লজ্জিত হয়।
ছোট্ট ছেলেটার কাছে অসতর্ক কথা বলে ফেলার জন্যে।
অবশ্য অজীন আর একবার প্রসঙ্গ বদলেছে ততক্ষণে, দিদি, ওর দোলনা নেই?
নাঃ! শুনছিস রাস্তায় পড়ে ছিল। আবার দোলনা!
তা এখন তো আর রাস্তায় পড়ে নেই, অজীন বিজ্ঞভাবে বলে, এখন তো সব কিনতে হবে। দিদি, ও আর একটু বড় হলে আমি গাড়ি ঠেলব ওকে।
সুমনার চোখে জল এসে যায়।
শিশুর সরলতায়।
শিশুর পবিত্রতায়।
ইস! কী লাল পা!
অজীন সেই লাল পা-টি তুলে ধরে টিপে টিপে আহ্লাদে বিগলিত হয়। চুলে হাত বুলোয়, আঙুলগুলি তুলে তুলে দেখে মোহিত হয়, তারপর সহসা বলে ওঠে, ইঃ এর মার কী কষ্ট! হারিয়ে ফেলে কত কাঁদছে হয়তো!
.
ছোট ছেলের নির্মল মনের এই সহজ চিন্তার কথাটা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে ভেবেছিল সুমনা।
ইস্ এর মার কী কষ্ট!
কত কাঁদছে হয়তো।
ঠিক ঠিক!
ছোট শিশুই সত্য নির্ণয় করতে পারে।
যাকে মনে মনে এ-যাবৎ সুমনা নিষ্ঠুর জঘন্য রাক্ষসী পিশাচী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে এসেছে, অদেখা সেই মায়ের উপর হঠাৎ সহানুভূতিতে মন ভরে যায় তার।
মনে পড়ে যায় রেলগাড়ির সেই বউটার কথা, বাবাঃ যা কষ্ট! ভাবলে অবাক লাগে এত কাণ্ডকারখানায় এক-একটা মানুষের পৃথিবীতে আসা
সেই কষ্টের ধন!
সেই দুঃখের নিধি!
তাকে ফেলে দিয়ে যেতে কত কান্না কেঁদেছে সে। তবু ফেলে দিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের পরম পবিত্র মহৎ সংসারে ওইটুকুর জায়গা হবে না বলে।
ওই কাচ কাচ চোখ, কী লাল হাত-পাওলা ছেলেটার দুরন্ত হাত-পা নাড়া দেখতে দেখতে বহুবার ভেবেছে সুমনা, উঃ কোন্ প্রাণে ফেলে দিয়ে গেছে!
আজ ভাবল, আহা কোন্ প্রাণেই ফেলে দিয়ে গেছে।
অজীনই একমাত্র।
অজীনকেই হয়তো কেউ এখনও জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ায়নি।
তাই ও যখন-তখন এ ঘরে ছুটে আসে, পোষা-ভাগ্নের অলৌকিক খেলাটুকু দেখতে।
২. চুলের মুঠি
সুমনা যখন ঘরের অন্য কাজ করে, তখন অজীন চিৎকার করে ওঠে, ও দিদি দিদি, নিজের চুলের মুঠি নিজে ধরছে! ও দিদি, নিজে নিজে কান মলছে!
সুমনা এসে হেসে হাত ছাড়িয়ে নেয়। জানে, এক্ষুনি কেঁদে উঠবে।
ওরকম করে কেন দিদি?
সুমনা হেসে বলে, বোধহয় নিজেকে নিজে শাস্তি দেয়। বলে,ওরে বোকা গাধা ছেলে কেন তুই তবুও বেঁচে থাকলি! কেন বাঘের পেটে শেয়ালের পেটে গেলি না।
যাঃ ও বুঝি কিছু বুঝতে পারে?
পারে। সব পারে। ছোট্ট বাচ্চারা যে ভগবান, জানিস না?
ভগবান!
ছোট্ট বাচ্চারা ভগবান!
অজীন খেলতে চলে যাবার পর সেদিন সুমনা ভেবেছিল, জগতে কত ছোঁদো কথাই না চলে আসছে।
কথার সেই অদ্ভুত অসার ছেঁদোত্ব নিয়ে কেউ কোনওদিন হাসাহাসি করে না। বলে না, হায় শিশুরূপী ভগবান! মানুষের দেওয়া সামান্য একটু পরিচয়পত্রের অভাবে তো তোমার ভগবানত্বের রসাতল প্রাপ্তি।