তুই থাম ছোটবউ! বড় জা স্বর্ণপ্রভা হাতের মালাগাছটা থলিতে ঢুকিয়ে বলেন,যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে বসিস তুই, বুদ্ধি তো আর পাকবে না কোনওকালে?গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলেন, ওই কুড়িয়ে পাওয়াটা গল্পকথা কিনা কে জানে!
গল্পকথা!
তা আশ্চয্যি কী! ওই সাঁওতালদের দেশে অমন ফুলের মতন ছেলে আসবে কোথা থেকে রে?
মালবিকা ঠোঁট উলটে বলে, আসতে আবার বাধা কী। কোনও সাহেবসুবোর দয়ার দান হতে পারে।
সংসার-অভিজ্ঞ স্বর্ণপ্রভা আরও ফিসফিস করে বলেন, বকিস কেন, বুনো মুনোরা অমন ফেলে ছড়ে দেয় না। দেবেই বা কেন। ধর্ম সমাজ এসবের তো আর বালাই নেই তাদের, সাহেব ছেলেয় নিলেও নেই। ওদের নয়। আরও নিচু গলায় কী একটু বলেন তিনি।
কিন্তু নতুন কিছু কি বলেন?
সুজাতা কি এই ফিসফিস সম্বন্ধে ধারণা করেনি? দেখেনি কি সবই তার প্রতিকূল? রাঁচি থেকে ফেরা অবধি এই সাত আট মাস ভুগছে না সুমনা জ্বর বমি হজমের গোলমালে? খিদে আর খাদ্যে রুচি নষ্ট হয়ে যায়নি তার? তার ওপরেই কষ্ট করে পরীক্ষার পড়া তৈরি আর পরীক্ষা দেওয়ার চাপে চোখমুখ বসে যায়নি বেচারার? আর পরীক্ষার পর একেবারে ঘরের কোণে বিছানা আশ্রয় করে পড়েনি?
সেইজন্যেই না সুজাতা মেয়ে নিয়ে অমন অস্থির হয়ে চেঞ্জে গিয়েছিল।
হায় ভগবান, যদি না যেত!
যদি ঠিক সেই সময় ভয়ানক একটা প্রতিবন্ধকতা আসত। যদি এই দেড় দেড়টা মাস এদের চোখের বাইরে না কাটাত।
যে ঘটনাগুলো নিতান্ত সহজ চেহারায় ছিল, সে ঘটনাগুলোই যেন এখন দাঁত খিঁচিয়ে উঠছে।
সুমনার যে অসুখটা এতদিন বাড়িসুষ্ঠু সকলের দুশ্চিন্তার ব্যাপার ছিল, সেটাই কুৎসিত সন্দেহের কালিতে কালো হয়ে উঠছে।
সুজাতা আসছিল কী একটা দরকারে ছোট জার কাছাকাছিবড় জার ফিসফিস দেখে সরে যায়।
সরে যায়, কিন্তু চলে যায় না।
চলে যায় না, সে কি কৌতূহলের বশে? না হাত পা বুক বড্ড বেশি কেঁপে ওঠার দরুন অক্ষমতায়?
কে জানে কী!
তবু দাঁড়িয়ে তো পড়ে।
আর দাঁড়িয়ে পড়ে বলেই মৃত্যুদণ্ডাদেশটা স্বকর্ণেই শুনতে পায়।
শুনে ছিটকে ওঠে না। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মালবিকা কিন্তু ছিটকে ওঠে।
বলে,ছি ছি দিদি! আপনার হাতে না জপের মালা!
জপের মালা তার কী–সদর্পে বলেন স্বর্ণপ্রভা, হ কথা বলব, গুরুর চরণ ছুঁয়ে বলব। মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখিস দিকিনি।
না দিদি, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না।
না পারলে আর কী করব। পরে সবই টের পাবি। এতবড় কাণ্ড কি আর লুকোনো থাকে! এই মতলব এঁটেই হাওয়া বদলের ছুতো। নইলে জগৎ সংসারে এত লোক হাওয়া খেতে যায়, কে কবে জঙ্গলের ধারে খোকা কুড়িয়ে পায় রে?
মেয়ের কাছে এসে আপসে পড়ে সুজাতা।
যে সর্বনাশের আশঙ্কা করছিল সেই সর্বনাশই যে ঘটল, সেই কথাই ব্যক্ত করে বলল, তবু বলব, তোর জেঠিকে আমি দোষ দিতে পারিনে। অন্যের হলে হয়তো আমরাও এই সন্দেহ করতাম।
করতে?
অদ্ভুত একটা বিদ্যুৎ ঝলসানো মুখে বলে সুমনা।
করতাম বইকী! কেন করব না? জগতে এমন কি ঘটে না? কতই ঘটছে। আমরা না হয় তাকে জানি, লোকে তো–
না, তোমরা আমার কিছুই জানো না। সুমনা স্থির স্বরে বলে, জানলে এখনও চেষ্টা করতে না আমার মন ফেরাবার। জেনে রেখো মা, আমি যে অসহায় প্রাণীটাকে আশ্রয় দিয়েছি, তাকে রক্ষা করবার জন্যে পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যদি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও, সে শাস্তিও মাথা পেতে নেব।
প্রতিকূলতাই শক্তির জন্মদাতা।
প্রতিকূলতা না এলে হয়তো এত জেদের শক্তি সঞ্চয় হত না সুমনার। অপরপক্ষের শিবিরে রণসজ্জা হচ্ছে অনুমান করে ও নিজের তূণে বাণ ভরে।
আর যতই ভাবতে থাকে এই এক মুঠো হাড়মাংস, এই এক কণা প্রাণ, এর বিরুদ্ধেই ওদের শিবিরে এত সজ্জা, ততই ভয়ংকরী হয়ে ওঠে সন্দেহে, অবিশ্বাসে, ঘৃণায়।
বড়রা কেউ কোনও দরকারে একবার ওর ঘরে ঢুকলে, বিদ্যুদ্বেগে গিয়ে ছেলেটাকে বিছানা থেকে তুলে কোলে চেপে নেয়, ঘোটরা এসে দাঁড়ালে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে তাদের গতিবিধির দিকে।
যদি বড়রা কিছু শিখিয়ে দিয়ে থাকে।
যদি এমনই কৌতূহলের বশে কোলে তুলতে গিয়ে ফেলে দেয়!
ঘর থেকে বেরোনো প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। নিতান্ত স্নান আহারের সময় ব্যতীত ঘর থেকে নড়ে না সুমনা। আর সেই সময়টুকু, এখনও জগতে যাকে এক কণা বিশ্বাস করে, সেই মানুষটাকে বসিয়ে রেখে যায়।
মানুষ বলেই যদি গণ্য করা যায় তাকে।
সে হচ্ছে তার সব ছোটভাই অজীন।
প্রথম দিন একমাত্র অজীনই দিদির ঘরে এসে অসীম কৌতূহলে ছোট্ট ছেলেটার রক্তাভ হাতের মুঠি আর পায়ের পাতা দুটিতে আলতো হাত রেখে প্রশ্ন করেছিল, রাস্তায় পড়ে ছিল?
সুমনা ছোটভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ রে, একেবারে জঙ্গলের ধারে। ওঁয়া ওঁয়া করে কান্না কোথা থেকে আসে, বলে ছুটে গিয়ে দেখি এই কাণ্ড! গায়ে কাঠপিঁপড়ে ধরেছে, তাই কাঁদছে।
অজীন বোধ করি তার কোনও একটি জানা গল্পের কাহিনী স্মরণ করে বলেছিল,নিশ্চয় ওকে নেকড়ে বাঘে চুরি করে এনেছিল। তাই না দিদি?
সুমনা অন্যমনা হয়ে বলেছিল, নেকড়ে বাঘে চুরি করে এনেছিল, না নেকড়ে বাঘেই ফেলে দিয়ে গিয়েছিল কে জানে!
বাঃ, ওরা মানুষখেকো কোথায় পাবে? তবে চুরি করে নিয়ে গিয়ে, খেয়ে না ফেলে মানুষ করে ওরা। তুমি যদি তুলে নিয়ে না আসতে, ও নিশ্চয় নেকড়ে-মানুষ হয়ে যেত দিদি।