জেদ ধরল বলে যথেচ্ছাচারের প্রশ্রয় দেওয়া যায় না কান্তি, শান্তিকুমার বলেন, স্নেহে অন্ধ হলে উভয় পক্ষের কারও মঙ্গল নেই।
কান্তিকুমার খুব স্থির স্বরে বলেন,বেশ, আমি তোমায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছি দাদা, তুমি এ বিষয়ে যা পারো করো।
শান্তিকুমার ভুরু কুঁচকে বলেন, আমি কী করব?
বোঝাও ওকে। তোমাকে ভয় করে, ভক্তি করে।
শান্তিকুমার কিছু বলার আগেই জেঠি রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন। বলে ওঠেন, এখন আবার বোঝানোর কথা! গোড়া কেটে আগায় জল! বলছ তো, কুড়িয়ে এনেছে। বেশ,বলি–তক্ষুনি দূর দূর করে ফেলিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে চান করিয়ে ঘরে তোলালে তবে না হত। এ এখন পরের পাপ ঘরে তুলে ফেলেছ। এখন কিছু করা শক্ত।
কান্তিকুমার গম্ভীর ভাবে বলেন, গোড়াতেই গোড়া শক্ত থাকে, এমন প্রকৃতিরও অভাব নেই সংসারে। সুমিকে তো তোমরা জানোই।
জানি বলেই তো জানি মেজ ঠাকুরপো, বলতে যাওয়া মুখমি। কথা থাকবে না। তবে এই ঠাকুর দেবতার বাড়িতে অতবড় একটা অনাচার সহ্য করাও তো শক্ত।
কান্তিকুমার এবার একটু হাসেন, তা এ অনাচার তো তোমার ঠাকুর দেবতার গায়ে গিয়ে লাগছে না বউদি।
লাগছে না–তাই বা বলি কী করে বলো? বাতাসেই অনাচার। রাস্তায় যারা ছেলে ফেলে দিয়ে যায়, তারা নিজেরা কী, আর তাদের ছেলে কী, তা তো আর তোমাকে বোঝাতে হবে না!
নাঃ, তা হবে না বটে।
আর একটু হাসির মতো করে চুপ করে যান কান্তিকুমার।
শান্তি আর একবার বলেন, যাই হোক, তোমাকে একটু মনে করিয়ে দিলাম কান্তি, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে স্বেচ্ছাচার চলে না। সকলের মুখই চাইতে হয়।
হ্যাঁ, সকলের মুখ চাইতে হয়।
এ দাবি ছোটভাই জয়ন্তীকুমারও তোলে। সেও এসে জানতে চায় ওই বিদঘুটে জীবটাকে কোথায় চালান করবে ঠিক করেছে মেজদা।
বলা বাহুল্য, সদুত্তর মেলে না।
উত্তরের বদলে প্রশ্নই করেন কান্তিকুমার, ঠিক আর করলাম কই?
জয়ন্তীকুমার ক্ষুব্ধ হাস্যে বলে,সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে আমার মতে ওখানেই কোনও অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসা উচিত ছিল তোমাদের। পাঁচজনের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে, তারপর ব্যবস্থা করতে যাওয়াটা বোকামি।
কান্তিকুমার এই ছোট ভাইটির সঙ্গে কখনওই কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না, কারণ বড় বেশি উত্তেজনাপ্রবণ জয়ন্তী, কথার পিঠে কথা কইতে হলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু এখন আর আলোচনা করার প্রশ্ন কান্তিকুমারের দিক থেকে নয়, এখন সে নিজেই আলোচনার সূত্র তুলেছে। অথবা সে অপর পক্ষীয় উকিল, আর কান্তিকুমার অভিযুক্ত আসামি।
হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট কান্তিকুমার সেন।
তাই কান্তিকুমার গম্ভীর হাস্যে বলেন, সন্দেহটা কীসের?
কীসের, তা বিশদ করে বোঝাতে হবে ভাবিনি।
ঠিক আছে। কিন্তু সন্দেহটা বাইরের পাঁচজনের মধ্যেই ধূমায়িত হচ্ছে, না নিজেদের ঘরও জ্বালাচ্ছে?
জয়ন্তীকুমার উত্তেজিত ভাবে বলে, কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেসব জানি না। তবে যেটা স্বাভাবিক সেটাই বোঝাতে এসেছি তোমাকে।
বোঝাতে এসেছে।
জয়ন্তী কান্তিকুমারকে!
হ্যাঁ, এমনিই হয়।
হাতি দিয়ে পড়েছে দেখলে ব্যাঙের পা নিসপিস করে।
অবাক হবার কিছু নেই কান্তিকুমারের।
অবাক হনও না।
মনুষ্য চরিত্রের বিচিত্র রহস্য দেখাই তো পেশা তাঁর।
তিন ভাইয়ের মধ্যে কান্তিকুমারই সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত, কান্তিকুমারই সকলের থেকে বেশি রোজগারি। কান্তিকুমার স্বভাবে রাশভারী, অথচ সদাপ্রসন্ন শান্ত স্নেহশীল। তাই কান্তিকুমার বাড়িতে সকলেরই একটু বিশেষ সমীহের বস্তু।
কান্তিকুমার সকলের সব সুবিধে অসুবিধে অভাব অভিযোগের দায় পোহান, তাই কান্তিকুমার সকলের কৃতজ্ঞতার পাত্র।
কিন্তু অবিরত সমীহ করতে করতে আর কৃতজ্ঞ হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে না মানুষ?
পড়ে।
তাই সেই উচ্চস্তরের মানুষটার কোথাও কোনওখানে দুর্বলতা ধরা পড়লে আহ্লাদের আর সীমা থাকে না লোকের। খানিকটা ক্লান্তি দূর করে বাঁচে।
কান্তিকুমারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারা গেছে এ একটা ভারী মজার ব্যাপার। তাই কারণটাকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বিরাট থেকে বিরাটতর করে তুলছে সবাই।
কিন্তু অপরপক্ষে যে একেবারেই কেউ নেই, তাও বলা যায় না। আছে। যে আছে, সে হচ্ছে ছোটবউ মালবিকা। মালবিকা অবশ্য বরাবর মুখরা বলেই খ্যাত, তাই যা বলে স্পষ্ট প্রখর।
বলে শাশুড়ি আর বড় জায়ের মুখের উপরেই।
বাবাঃ! শুনে শুনে আর না বলে পারছি না। কদিন ধরে কি তিলকে তাল করছেন আপনারা! একটা সদ্যোজাত শিশু, তার জাত আছে না ধর্ম আছে? না সে নিজে কোনও পাপের পাপী? তাকে একটু আশ্রয় দিলে জাত ধর্ম সব রসাতলে যাবে? এতবড় বাড়িতে এত ছেলে-পুলে মানুষ হল, হচ্ছে, আর ওই একমুঠো ফুলের মতন ছেলেটা, এত ভার লাগছে আপনাদের? কুড়োনো ছেলে বলে একটা কথা তো আছেও জগতে!
শাশুড়ি যোগমায়া বিরক্ত কণ্ঠে বলেন,তোমার বুদ্ধিকে বলিহারি দিই ছোটবউমা! বাড়িতে এত ছেলে মানুষ হচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনা করছ? আমাদের ঘরের ছেলে আর ওইটা? কোন্ পাণ্ডির পাপের ফল তার ঠিক নেই।
মালবিকা ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, এই আমাদের বাড়ির মতো পুণ্যবতীদের বাড়িরই কোনও পাষণ্ডির বোধহয়। ওই ছোট্ট বাচ্চাটার পাপ-নিশ্বাসে পাছে সেই পুণ্যবতীদের পুণ্যের ভরা উপে যায় তাই ওটাকে শেয়াল কুকুরের মুখে ফেলে দিয়ে, নিজেরা গঙ্গাস্নান করে পুজোর চন্দন ঘষতে গেছে।