সুধানাথ মিত্র
বাঁচতে তো হবে!
আশ্চর্য, আজও পৃথিবীতে এমন কেউ রয়েছে, যে মলিনার বাঁচার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। সেই বাঁচার জন্যে রসদ জোগান দিতে আসছে।
নিশ্বাস ফেলে বলল, নামিয়ে দাও।
এরপর আর নগেন গিন্নি, দাস গিন্নি, মণ্ডল গিন্নির নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব হল না। ওঁরা এলেন দাঁত খুঁটতে খুঁটতে, ভিজে কাপড় নিংড়োতে নিংড়োতে।
বাজার কে করে দিল? সুধাবাবু বুঝি? তাই ভাবছি উনিই তো দেখাশোনা করছেন। আমরাও তাই নিশ্চিন্দি আছি। একজন যখন সমগ্র ভার নিয়েছে–
মণ্ডল গিন্নি বলেন, সুখদাদি চেপে গেল, ভাব দেখাচ্ছে যেন ঘোষ মশাই অমনি থাকতে দিয়েছেন। কিন্তু ধর্মের ঢাক আপনি বাজে। সুধাবাবুই নাকি এ ঘরের ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছেন। তাই ইনি বলছিল, তোমরা আর অজিতবাবুর বউয়ের কথা নিয়ে মন খারাপ করছে কেন? অজিতবাবু নেই, সুধাবাবু তো তার বাড়া করছেন। আচ্ছা, তা মলিনা, মাছটা কেন খাওনা? সবই যখন রেখেছ–
মলিনার প্রতিজ্ঞা মলিনা মুখ খুলবে না। তাই মলিনা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। শুধু মনে মনে বলে, এ সন্দেহ আমার হয়েছিল, তবুও জোর করে ওই অর্থ পিশাচটাকে দেবতা ভাবছিলাম। কিন্তু এ আমি কোথায় চলেছি?…কেন নিচ্ছি এত? এ ঋণ আমি শোধ করব কি দিয়ে!
রাত্রে শুয়ে আকুল হয়ে বলে, তুমি কি সত্যিই আর আসবে না?…তুমি কি সত্যিই জন্মের শোধ চলে গেছ? সুখদার চোখই নির্ভুল?…আমি আসার ছলনায় ভুলে ভুল দেখেছি! তাই ওরা আমায় একঘরে করে রেখেছে, আমায় ঘেন্না করছে।…কিন্তু আমি ওদের চোখের সামনে এই ভাবে কি করে কাটাব?
অনেকক্ষণ ভেবে মলিনা ঠিক করল বামুনের মেয়ে, রাঁধুনী বৃত্তি ধরবে। এভাবে দয়ার অন্ন খাওয়ার চেয়ে চাকরি করে খাওয়া ভালো।
তাতে পেটের ভাত জুটবে, ঘরের ভাড়াও হবে।
লজ্জা করবে?
মাথাকাটা যাবে?
তা প্রথম প্রথম হয় তো যাবে। তারপর সয়ে যাবে।
কিন্তু স্বামী নিরুদ্দেশ এই পরিচয় কি সমাজে মান্য? কথাটা যেন হাস্যকর। তার থেকে ওদের মনস্কামনাই পূর্ণ হোক। মলিনা বিধবার সাজ সেজেই–
শেষটা আর ভাবতে পারল না মলিনা। চোখের জলে একাকার হয়ে গেল।
এঁরাও তেমন সুখ পেলেন না।
মলিনা যদি প্রতিজ্ঞা করে থাকে একেবারে কথা কইবে না, কত আর এগোনো যাবে?
এক উপায় আছে, মাধব ঘোষকে দিয়ে বলানো, ভদ্র বাড়িতে এসব অনাচার চলবে না।
অনাচার ছাড়া আর কি? একটা লোক অপঘাতে মরল, আর মরতে না মরতে বাসার আর একটা লোক তার পরিবারকে নিয়ে নিল, এর মতো অনাচার আর কি আছে?
তা নিয়ে নেওয়া ছাড়াই বা আর কি?
খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, ঘরভাড়া দিচ্ছে, বাকিটা কী? শেষ যা হবে তা তো বুঝতেই পারা যাচ্ছে। নেহাত পাঁচজনের চোখের সামনে তাই, নইলে এতদিনে সবই হত।
এই কথাই বোঝাতে হবে মাধবকে।
ভাড়াটে গেলে ভাড়াটে হবে না, সে ভয় তো আর নেই এ যুগে? বরং বেশি ভাড়ায় ভাড়াটে আসবে। এই স্বভাবচরিত্রহীন ছেলেটাকে আর মলিনাকে নোটিশ দিক মাধব ঘোষ।
আক্রোশ মেটাবার এই চরম উপায় আবিষ্কার করে এরা।
আক্রোশ?
তা আক্রোশ নয় কেন? দুঃখে পড়ল, অথচ দুঃখী হল না, এ মেয়েমানুষকে কখনও চোখের ওপর সহ্য করা যায়?
দাস গিন্নি ভেতরে ভেতরে দুটো ভাড়াটেও ঠিক করে ফেললেন মাধব ঘোষের। তারপর পাড়লেন কথাটা
৩. রাত ছাড়া দেখা হয় না
রাত ছাড়া দেখা হয় না।
মলিনা তখন সুনাথের কাছে এসে চাকরি জুটিয়ে দেবার দরবার করছিল। টর্চ নিভিয়ে চাবির মোচড় দিয়ে দরজাটা সবে খুলেছে সুধানাথ, পিছন থেকে মলিনা বলল, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে ঠাকুরপো।
সুধানাথ থমকে তাকাল।
তারপর বলল, বলুন।
সুধানাথের ঘরে লাইট নেই। মলিনার ঘরে আছে। সেই লাইটের কিয়দংশ এসে এ দাওয়ায় পড়েছিল। আর মলিনার ঘরটা যে খালি, তা খোলা দরজা দিয়ে দেখা দিচ্ছিল।
সুধানাথের অস্বস্তি হচ্ছিল।
তবু বলল, বলুন।
মলিনা বলল।
সুধানাথ চমকে বলল, চাকরি? কি চাকরি?
তা আমি কি আর আপিসের চাকরি চাইছি? বামুনের মেয়ের যাতে লজ্জা নেই, সেই কাজই করব। একটা রাঁধুনীর কাজ তুমি আমায়–
কথা শেষ হবার আগেই মাধব ঘোষের শ্লেষ্মাজড়িত ভারী গলার আওয়াজ বেজে উঠল। সুধানাথবাবু, ভেবেছিলাম কিছু বলব না। কিন্তু না বলেও তো পারছি না। মাধব ঘোষের বাসাটা বিন্দাবন নয়; বুঝলেন? এই আপনাকে আমি নোটিশ দিচ্ছি—তিনদিনের মধ্যে আপনার ওই বান্ধবীকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে সরে পড়বেন।
সুধানাথ গম্ভীরভাবে বলে, তিনদিনের নোটিশ দিচ্ছেন? বাড়িভাড়া আইনটা বুঝি আপনার জানা নেই?
মাধব ঘোষ অবশ্যই এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল, এবং উত্তরও জুগিয়ে রেখেছিল, তাই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, জানব না কেন? খুব জানা আছে। আবার হাটে হাঁড়ি ভাঙবার কায়দাও জানা আছে। কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত করে যদি থাকতে চান তো থাকুন, তবে অজিতবাবুর পরিবারের মতন খারাপ স্ত্রীলোক আমার বাসায় রাখলে, এরপর আমার ভদ্দর ভাড়াটেরা চলে যাবে। সেই কথাটাই ওঁকে জানিয়ে দেবেন।
মাধব ঘোষ চলে যায়।
বেশ গট গট করেই যায়।
সমস্ত ঘরের দরজা-জানালা যে ঈষৎ উন্মুক্ত তা দেখতে তার বাকি থাকে না। বোঝে কাজটা সুচারু হয়েছে।
মলিনা?
সে বোধ করি, আজকাল নিতান্ত শক্ত হয়ে গেছে বলেই সহজভাবে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।