মলিনাও উঠেছে।
নাইছে, খাচ্ছে।
কদিন বেশি ভাড়ার ভাড়াটের গৌরব নিয়ে আলাদা কলতলায় নাইবে? মাসটা শেষ হলেই তো বিরাট একটা দৈত্য হাঁ করে দাঁড়াবে।
মলিনা মাছ, মাংস খায় না, কিন্তু মলিনা লোহা, সিঁদুরও ফেলেনি। মলিনা যেন ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলছে। এর চাইতে অজিত যদি স্পষ্টাস্পষ্টি মারা যেত, মলিনা বুঝি স্বস্তি পেত।
কিন্তু অজিত তো স্পষ্ট মারা গেল না! অজিত যেন একটা ধূসর শূন্যতায় হারিয়ে রইল। সুখদা জোর গলায় বলেছে, ও-ই অজিতের লাশ, কিন্তু মলিনার মন নেয়নি।
যতই বিকৃত হোক, ওই হাত পা কি অজিতের?
সুখদা বলেছিল, ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে গেছে, এখন তুমি হাত পায়ের গড়ন খুঁজছ?
কিন্তু না খুঁজলে কোন্ খুঁটিটাকে চেপে ধরবে মলিনা?
মলিনা ভগবানের কাছে শতবার নালিশ জানায়, স্পষ্ট কেন বুঝিয়ে দিলে না ঠাকুর! সে যে আমার শতগুণ ভালো ছিল। রাজ্যসুদ্ধ মেয়েমানুষ বিধবা হচ্ছে, আমিও হতাম। এ তুমি আমাকে কী করে রাখলে?
অথচ ওই গিন্নিগুলোর কথা শুনে, বিধবা মূর্তি করে, অজিতের নামে পিণ্ডি দেবে, সেও যে কিছুতেই মন সায় দেয় না।
তাই ঘর থেকে আর সহজে বেরোচ্ছে না মলিনা, কোনোমতে আড়ালে আড়ালে কাটাচ্ছে।
মাসের প্রথম দিকে হারিয়ে গেছে অজিত, আর ঠিক তার আগের দিনই মাসকাবারী বাজারটা করেছিল। সুধানাথ এক ফাঁকে, কোনো সময়, দাওয়ায় দুটো আলু পটল রেখে যায়, দিনান্তে একবার উঠে মলিনা দুটো ভাতেভাত ফুটিয়ে নেয়। বাকি সময় শুয়ে থাকে।
এই বারো ঘরের ঘরণীদের কাছে সে যেন একঘরে হয়ে গেছে।
ওর ওই বিধবা না হবার জেদ, আর সুধানাথের ওকে দেখাশোনা, ওদের চক্ষুশূল। আর এঁদের রূঢ় মন্তব্য ও হৃদয়হীন ঔদাসীন্য, মলিনার যেন মর্মান্তিক লাগে।
প্রতি মুহূর্তে উঠে পালাতে ইচ্ছে হয় মলিনার।
তার সেই গর্ব, সেই অহঙ্কার, সব বিসর্জন দিয়ে এভাবে পড়ে থাকা কি সহজ?
তাছাড়া–
পড়ে থাকতেই বা কদিন দেবে মাধব ঘোষ? ও মাসের দোসরা হলেই তো এসে হয় ভাড়া চাইবে, নয় নোটিশ দেবে!
.
কিন্তু আশ্চর্য! দশ, বারো, পনেরো তারিখ হয়ে গেল, মাধব ঘোষ না দিল নোটিশ, না চাইল ভাড়া। একবার করে যখন এদিকে এসে মলিনার তত্ত্ব নিচ্ছিল, তখন মলিনা অস্ফুটে বলেছিল, আপনার–ভাড়াটা–
মাধব ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, থাক, থাক, ও নিয়ে এখন আর তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। আমি তো আর পিশাচ নই!
মলিনা ভেবেছিল, পিসাচের আবরণেও তা হলে মানুষ থাকে। এই সব ভালো লোকেরা এই ব্যবহার করছেন, অথচ চিরদিনের অর্থপিশাচ মাধব ঘোষ–
কিন্তু এ কী জীবন হল মলিনার!
মাধব ঘোষ দাক্ষিণ্য করে বাসার ভাড়া নেবে না, কে কোথাকার সুধানাথ দয়া করে দুটো বাজার করে দিয়ে যাবে, আর মলিনা একবেলা তাই ফুটিয়ে খাবে, আর বাকি সময় মেঝেয় পড়ে পড়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করবে?
আর কিছু নেই?
ভবিষ্যৎ বলে একটা বস্তু অজিতের মতোই ধূসর হয়ে থাকবে?
তা ছাড়া, একঘরে হয়ে থাকার মতো কষ্ট আর কি আছে?
স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় মলিনা যে একসময় নিজেই ওদের হেয় জ্ঞান করে ওদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতো, সে আর এখন মনে পড়ে না মলিনার।
ওরা যে রাঁধছে, বাড়ছে, খাচ্ছে, বেড়াচ্ছে, ছেলে ঠেঙাচ্ছে–এক কথায় জোর কদমে সংসার করছে, অথচ কদাচিৎ মলিনার ঘরে উঁকি মারছে না, এতে শুধু কষ্টেরই নয়, অপমানেরও।
আসে, এক আধবার স্বপনের মা আসে।
বলে, মলিনাদি, চৌকিটায় শুলে তো পারো। রাতদিন মাটিতে শুয়ে শুয়ে রোগে ধরলে দেখবে কে?
বলে, বুঝলে মলিনাদি, গিন্নিরা সব তোমার ওপর খাদ্ধা। এই যে আমি একটু এসেছি, তা সব ভালো চক্ষে দেখে না।…
আবার এ কথাও বলে, সুধানাথবাবুর সঙ্গে বুঝি তোমার আগেকার চেনাজানা ছিল ভাই? মলিনা কোনো কথারই উত্তরই দেয় না।
মুখরা মলিনা যেন মূক হয়ে গেছে।
কিন্তু মলিনাকে আরও মূক করে দেবার মতো আরও এক ঘটনা ঘটল।
একটা মুটে এসে মাসকাবারি বাজার এনে মলিনার দাওয়ায় নামাল। চাল, ডাল ফুরিয়ে এসেছিল। দুজনের ভাগ একজনে খেলেও, এসেছিল। একমাস যে দুমাসে ঠেকতে বসেছে। ফুরিয়ে এসেছিল, মলিনা ভাবছিল, না খেয়ে মারা যায় না? মন্দ কি, যদি মলিনা সেই পদ্ধতি ধরে?
হঠাৎ—এই সময় এই।
মলিনা বলল, তুমি ভুল করছ। এ ঘর নয়। মুটেটা বলল, এই তো সাত নম্বর ঘর! চিঠি আছে।
বাড়িয়ে ধরল একটা কাগজ।
চিঠি আছে।
এ কি অদ্ভুত কথা!
মলিনার চিঠি আছে। যে মলিনার তিনকুলে একটা মাসি বলতে নেই, এতবড়ো দুর্ঘটনা ঘটে গেল, মলিনার কোনো কুল থেকে কেউ খবর নিতে এল না, তাকে আবার চিঠি কে দেবে?
দেখেশুনে আর ঘরেরা তো এমন সন্দেহও প্রকাশ করছে, বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রী তো? না কি ঘর ভেঙে বেরিয়ে আসা? তিনকুলে কেউ নেই, এমন হয়?
কিন্তু হয়েছে।
সত্যিই কেউ নেই। আর যদিও সুদূরে কেউ থেকে থাকে, মলিনা তো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। আজ মলিনা তাই চিঠি আছে শুনে নিথর হয়ে গেল।
হে ঈশ্বর, এমন হয় না যে, এ চিঠি অজিতের!
দুষ্টুমী করে কোথাও লুকিয়ে বসেছিল। এখন খেয়াল হয়েছে মলিনার চাল, ডাল ফুরিয়েছে, তাই সব কিনে কেটে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে।–”মলিনা, আমি অজ্ঞাতবাসে আছি, কিন্তু তোমার বাজারটার চিন্তায় শান্তি নেই। তাই–
কল্পনাটুকু মুহূর্তের।
কাগজের টুকরোটুকু খুলে ধরল মলিনা। লেখা রয়েছে, আপত্তি করবেন না। বাঁচতে তো হবে।