উঁচুনাকী কান্না জুড়েছে কেন? নিশ্চয় বিপদ আপদ ঘটে গেছে কিছু।
টর্চটা নিভিয়ে ফেলে বলল, কী ব্যাপার ঘোষ মশাই?
ঘোষ মশাই তাঁর বাসার এই ভাড়াটেটিকে একটু প্রীতির চক্ষে দেখেন। কারণ বউ ছেলের ঝামেলা নেই, অভিযোগ অনুযোগের বালাই নেই। সারাদিন তালা ঝোলানো ঘরটার জন্যে মাসে মাসে পুরোদস্তুর ভাড়াটি দেয়। এবং সকলের আগেই দেয়। দোসরা ভিন্ন তেসরা হয় না। যেটা তার এই বাকি তেরো ঘরের কাছে আশাই করা যায় না।
সুধাকে নিয়ে মাধব ঘোষের চৌদ্দ ঘর ভাড়াটে। সুধাই সেরা।
তাই সুধার প্রশ্নে মাধব ঘোষ যেন জজকে সামনে পেল। নালিশের সুরে বলে উঠল, এই দেখুন মশাই, অজিতবাবু সময়ে বাসায় ফেরেননি বলে অজিতবাবুর পরিবার আমাকে থানা পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন।
থানা পুলিশ!
মাধবকে ভীতি প্রদর্শন?
ব্যাপারটা বুঝতে কিছু সময় লাগল সুধানাথের। তারপর–অনেকের অনেকরকম কথা, সুখদার চিপটেন এবং মলিনার কান্না থেকে সবটা বুঝে নিল পরিষ্কার করে।
অজিত যে নিত্য সন্ধ্যা ছটায় ফেরে, এবং আজ এখনও ফেরেনি এটা শুনে সত্যিই চিন্তা হল তার। উড়িয়ে দেবার মতো কথা নয়।
রাত্তিরভোর ঘুমিয়ে সকালে যা হয়, করা যাবে এটাও যেন অসংগত ঠেকল তার কাছে। তাই প্রশ্ন করল, তা উনি কাজটা করেন কোথায়?
মলিনা ভাঙা গলায় বলল, কুন্তল বিলাসের অফিসে।
কুন্তল বিলাস? বড়ো অফিস? টেলিফোন আছে?
তা, জানি না–মলিনা কাতর কণ্ঠে বলে, তবে আপিস মস্ত বড়ো। অনেক রাত অবধি এই সব ওষুধ পত্তর তেল টেল তৈরি হয়—
অনেক রাত অবধি হয়–
সুধানাথ বলে, আচ্ছা দেখি, যদি অবনী ডাক্তারের ডাক্তারখানাটা এখনও খোলা থাকে, টেলিফোন করার সুবিধে হয়।
নগেনবাবু আগ বাড়িয়ে বলেন, সে কথা কি আর আমরা ভাবিনি হে? ভেবেছি। কিন্তু ডাক্তারখানা কখন বন্ধ হয়ে গেছে।
সুধানাথের অবশ্য বুঝতে দেরী হয় না, ভাবনাটা নগেনবাবু এখনই ভাবলেন। তাই মনে মনে হেসে বলে, আচ্ছা দেখি চেষ্টা করে। যদি ভোলাতে পারি। কম্পাউন্ডারটা তো শুয়ে থাকে ভেতরে।
কম্পাউন্ডার দীনবন্ধুর সঙ্গে ভাব আছে সুধানাথের। দীনবন্ধু একই রেস্টুরেন্টে খেতে যায় মাঝে মাঝে। সুধানাথ বিনা টিকিটে সিনেমা হলেও ঢুকিয়ে দেয় কখনও সখনও বন্ধু দীনবন্ধুকে। ছবি যখন মরে আসে, ভীড় হয় না, তখন দামী-সিটেই বসিয়ে দেয়।
সেই যোগসূত্রের ভরসায় বেরিয়ে পড়ল সুধানাথ।
যারা সকাল দেখাচ্ছিল, তারা সুধানাথের এই অর্বাচীনতাকে ব্যঙ্গ করে খেতে শুতে গেল, মাধব ঘোষ আবার সুখ-শয্যায় অঙ্গ ঢাললো গিয়ে।
শুধু সুখদা দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে রইল, শেষ মজা দেখবার জন্যে। বসে রইল মদনাকে কাছে বসিয়ে। গোলমালে ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে সে। মায়ের গায়ে ঠেকা দিয়ে বসে বসে হাই তুলছে।
আর মলিনা নিজের দাওয়ায় উঠে গিয়ে এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কঁদছে।
প্রতীক্ষার প্রহর অনন্ত!
মলিনার মনে হয়, সে বুঝি সারারাত ধরে কাঁদছে। মনে হয়, ওই ইয়ার ছোঁকরাটা নির্ঘাত মজা দেখতে থাকে বৃথা আশ্বাস দিয়ে আর কোথাও শুতে চলে গেল।
নইলে অবনী ডাক্তারের বাড়ি আবার কতদূর!
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সুধানাথ যতটা সম্ভব দ্রুত গেছে। জানলায় টোকা দিয়ে দীনবন্ধুকে তুলিয়ে ডিরেক্টরি দেখে কুন্তল বিলাসের অফিসে এবং সেখানে সাড়া শব্দ না পেয়ে মালিকের বাড়িতে ফোন করে তথ্য সংগ্রহ করে, ছুটে ছুটে এসেছে।
ওকে ঢুকতে দেখেই, মলিনা চোখের কাপড় নামিয়ে ডুকরে ওঠে, খবর কিছু পেলে ঠাকুরপো?”
জীবনে কোনোদিন সুধানাথকে ঠাকুরপো বলেনি মলিনা। কথাই কয়েছে কি না সন্দেহ। পরস্পরের সঙ্গে কথা চালনার যে প্রধান কারণ—জল কল, সে কারণ মলিনার নেই। তাই কথাও নেই বড়ো একটা কারও সঙ্গে।
কিন্তু আজকের কথা স্বতন্ত্র। আজ মলিনা কারে পড়েছে। তাই ঠাকুরপো সম্বোধনে অন্তরঙ্গ হতে চাইছে তার সঙ্গে, যে তার বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে।
ছেলেটার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে—ভেবেছে মলিনা।
কই, একটা মানুষও তো এক পা বেরিয়ে এক তিল চেষ্টা করতে এগোয়নি? তখন তবু সময় ছিল। এখন তো সত্যিই অসময়। এই মনুষ্যত্বযুক্ত মানুষটাকে তাই অসহায়তার দুঃখময় মুহূর্তে নিকট সম্পর্কের সম্বোধনে আঁকড়াতে ইচ্ছে করল মলিনার।
নতুন এই সম্বোধনটা সুধানাথের কানেও মিষ্টি ঠেকল। কিন্তু এখন তো ভালো লাগালাগির সময় নয়। এখন যে বড়ো দুঃসময়। কুন্তল বিলাসের মালিক যা বললেন, সে তো আরও চিন্তার কথা।
মাত্র ছঘণ্টাই তাহলে সমাজে অনুপস্থিত নয় অজিত ভটচায, তেরো চৌদ্দ ঘণ্টার হিসেব মিলছে না।
রাত দুপুরে ফোন আসাতে ক্রুদ্ধ বড়োলোক বিরক্ত ভাবে জানিয়েছেন, অজিতের অসততায়। বিরক্ত হয়ে তিনি আজ তাকে কাজে জবাব দিয়েছেন। বেলা এগারোটার সময় তার অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে অজিত ভটচায়। তারপর তার আর কোনো খবর তিনি জানেন না। বাড়ি ফেরেনি? স্ত্রী কান্নাকাটি করছে? কি করবেন। দুঃখিত।
কটাস করে কেটে দিয়েছিলেন কানেকশান।
অসততার কথাটা উল্লেখ করল না সুধানাথ, শুধু বলল, কী যেন বচসা হওয়ায় মালিক নাকি কাজে জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন সকাল বেলাই। বেলা এগারোটার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন।
ও ঠাকুরপো, কোথায় সে গেছে তবে? সারাদিন কোথায় আছে? চাকরি যাওয়ার ঘেন্নায় কিছু ঘটিয়ে বসেনি তো?