সুখদা টিপে টিপে বলতে লাগল, ওমা, এতক্ষণ কি তুমি ঘুমোচ্ছিলে মলিনা? মানুষটা আসে সন্ধেবেলা, আর এখন এই রাত্তির এগারোটা! এখন তুমি তোক জানাজানি করছ বাড়ি আসেনি বলে। সময়ে টের পেলে তো–পাঁচজনে একটা বিহিত করতে পারতো!
মলিনার এখন দুঃসময়।
তাই মলিনা চট করে মুখে মুখে উত্তর দিল না। নইলে কি, না বলে ছাড়তো, একদণ্ড দেরী দেখেই যদি ডাক ছেড়ে লোককে উত্যক্ত করি, তাহলেও তো দুষতে গো!
এখন বলল না।
এখন মাধব ঘোষের কথার উত্তর দিল। যেমন যায় তেমনিই গিয়েছিল। শরীর তো ভালোই ছিল। এখন খবর নেবার কি হবে বলুন?
মাধব ঘোষ নীরস গলায় উত্তর দেয়, এখন আর এই রাতদুপুরে কি বলব বাছা?
মলিনা নয় বিপদেই পড়েছে। তবে স্বভাবটা কি একেবারে যাবে? যে স্বভাব না কি মরলেও যায় না।
তাই সে-ও বিরস গলায় বলে ওঠে, তা আপনার বাড়ির ভাড়াটে, দায়িত্ব তো আপনারই, একটা যদি বিপদ আপদ ঘটে থাকে, থানা পুলিশ হয়, আপনাকেই আগে ধরবে।
থানা পুলিশের কথাটাই মনে আসে মলিনার। কারণ, ওর মনে সেই চুরির কথাই পাক খাচ্ছে। কি জানি, অজিত শুধুই বাড়িতে এক আধ ছিটে আনে, না সরিয়ে ফেলে বাইরে মোট মোট বেচে। এমন তো কত শোনা যায়, তলে তলে মনিবকে ফাঁক করে কর্মচারীতে।
মানুষকে বিশ্বাস নেই।
স্বামী বলেই যে অজিতকে মলিনা সত্যসন্ধ পুরুষ ভাববে তার মানে নেই।
কিন্তু থানা পুলিশের কথায় মাধব ঘোষ শিউরে উঠল, থানা পুলিশ কেন? থানা পুলিশ কেন? তেমন সন্দ আছে তাহলে?
মলিনার সেই কান্না ভাবটা কমে এখন ঝগড়াটে মূর্তি ফুটে ওঠে। সে-ও সমানে সমানে বলে, কেন, শুধু চুরি ডাকাতি করলেই থানা পুলিশ হয়? পথে বিপদ হলে হয় না? এমন কিছু খোকা নন আপনি যে জানেন না। এতগুলো পুরুষ বাড়িতে থাকতে, বাড়ির একটা মানুষ বেঘোরে হারিয়ে যাবে? খোঁজ হবে না?
এতক্ষণ যারা সহানুভূতিতে বিগলিত হচ্ছিল, তারা সহসা মলিনার এই রূপান্তরে অন্যমূর্তি নেয়। বিরূপ মন্তব্যের ফিসফিসিনি ওঠে। মাধব ঘোষের সঙ্গে লাগছিল, বেশ হচ্ছিল। বাড়িওলাকে কেউ দুচক্ষে দেখতে পারে না। এই ছুতোয় ও একটু অপদস্থ অপমানিত হয় তোক।
কিন্তু হঠাৎ এ আবার কি!
কেউটে যে ল্যাজে ছোবল মারতে এল আর তবে কে সহানুভূতিতে গলবে?
নগেনবাবুর স্ত্রী গলা তুলে বললেন, বুঝলাম তো সবই। কিন্তু চারদিকের বাস ট্রাম বন্ধ হয়ে এল, লোকে কে কি করবে? যা করবার সকাল হলে করা হবে।
একথায় হঠাৎ আবার মলিনার ভেতরের কান্নার সমুদ্র উথলে উঠল। কেঁদে উঠেই বলল, মেয়েমানুষ হয়ে একথা কোন প্রাণে বললেন মাসিমা? এই সারারাত আমি কি ভাবে কাটাব, তা ভাবছেন না?
নগেনবাবুর স্ত্রী কি উত্তর দিতেন কে জানে, ঠিক এই সময় সুধানাথ ফিরল কাজ থেকে। সুধানাথের চাকরি হচ্ছে, সিনেমার টিকিট চেকারি। তাই লাস্ট শো সেরে ফিরতে ওর প্রায় বারোটা বাজে। বাইরে থেকে খেয়েই ফেরে।
ও যখন ফেরে তখন বাড়ি নিশুতি হয়ে যায়, উঠোনের ছোটো দরজাটা ভেজানো থাকে। নিঃশব্দে ঢুকে আস্তে দরজাটায় খিল লাগিয়ে নিজের কোণের দিকের ঘরটার সামনে দাঁড়ায়, চারিদিকের ভিতর থেকে বন্ধ ঘরগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে, হয় তো বা একটা নিশ্বাস ফেলে। তারপর নিজের বাইরে থেকে তালা লাগানো ঘরটা আস্ত একটি চাবির মোচড় দিয়ে খুলে ঢুকে পড়ে।
আলো-টালো জ্বালে না, টর্চটা টিপে একবার দেখে যেন, তারপর বাইরের উঠোনের মস্ত চৌবাচ্চাটার তলায় ঠেকা এক ছিটে জল মগ ঠুকে ঠুকে তুলে হাত মুখ ধুয়ে, ঘরে এসে বাইরের জামা-পোশাক বদলে শুয়ে পড়ে।
ঘরের মধ্যেই টাঙানো দড়িতে লুঙ্গিটা শুকোতে দিয়ে যায় সকালে, সেটাই ওর রাত কাপড়।
বিছানা কোনোদিন ভোলা হয় না, অতএব পাতার কথাও ওঠে না। তিন-চার মাস অন্তর এক আধদিন সকালে বিছানার চাদরটাকে নিয়ে কাচতে দেখা যায় সুধানাথকে।
সকালের দিকে আর একটা কি যেন কাজ করে। খাওয়াটা সেখানে জোটে। বোধহয় কোনো মাড়োয়ারি গদিতে খাতা-পত্তর দেখে। সেখানে কর্মচারীদের জন্যে রান্না হয়। মাছ মাংস নয়, সাত্ত্বিক।
সকালে ওই সাত্ত্বিক খানা, রাত্তিরে রেস্টুরেন্টে রুটি মাংস। এই চালিয়ে চলেছে সুধানাথ যতকাল মা মরেছে তার।
বউ?
না, বউ বস্তুটা আর কপালে জোটেনি তার। কে দেখেশুনে দেয়, এইজন্যেই হয়ে ওঠেনি। তারপর তো মেঘে মেঘে বেলা যাচ্ছে। বন্ধুবান্ধবরা কিছু বললে বলে, বেশ আছি বাবা! সুখের চেয়ে সোয়াস্তি ভালো।
কিন্তু রাত্রে বাসায় ফিরে ঘরে ঘরে বন্ধ দরজা দেখে নিশ্বাস পড়াটাকে আটকাতে পারে না। নিজের ঘরটাকে একটা ঘৃণ্য জায়গা বলে মনে হয় তার।
আজও যথারীতি টর্চ টিপে টিপে গলিটা পার হয়ে এসেছিল সুধানাথ, দরজা ঠেলতেই চমকে উঠল।
সব ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বালা, আর ঘরের মালিকরা সকলেই প্রায় ঘরের বাইরে।
মাঝখানে নাক উঁচু মলিনা বসে কঁদছে। বাসার কারও সঙ্গেই খুব একটা ঘনিষ্ঠতা নেই সুধানাথের। সম্পর্ক তো মাত্র সেই সকাল বেলা ছটা থেকে সাতটা অবধি। যেটুকু সময় জল আর কল নিয়ে বচসা।
তবে মলিনার আলাদা কলঘর আছে বলে, আর মলিনা সেই কলঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচজনের সামনে দাঁতে বুরুশ করে বলে, সুধানাথ ওকে দেখতে পারে না। মনে মনে নাম দিয়েছে–উঁচুনাকী।
কিন্তু হঠাৎ কী হল?