অথচ সুধানাথ ভাবে মলিনা কৃচ্ছ্বসাধন করছে। মলিনার চিন্তার ধারা বদলেছে বৈ কি।
আচ্ছা, এই মলিনাকে কি লোকে সতী মেয়ে বলবে?
অকস্মাৎ কর্পূরের মতো উবে যাওয়া স্বামীর জন্যে যে কেঁদে কেঁদে নিজকে কর্পূরের মতো শেষ করে ফেলছে না, পরপুরুষের ভালো-লাগা, ভালো-না-লাগার চিন্তায় দিনের অধিকাংশ ব্যয় করে ফেলছে, এ মেয়ে অসতী ছাড়া আর কি?
হঠাৎ একটা পোড়া গন্ধে চমক ভাঙল।
আর সঙ্গে সঙ্গে একটা গলার স্বরেও।
এই সেরেছে, রাঁধতে রাঁধতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি? কি পুড়ল?
মলিনা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বিচিত্র একটু হেসে বলে, তোমার কপাল!
আমার কপাল!
হেসে ওঠে সুধানাথ, সে কি তোমার ওই কড়াতে চাপানো ছিল নাকি?
ছিলই তো! ওই কপালকে লোহার কড়াইতে করে গনগনে আগুনে চড়িয়েই রেখেছি তো সর্বদা, পুড়ছে আঙার হয়ে।
সুধানাথ একটা সিঁড়ি টেনে নিয়ে বসে বলে, পোড়া কপালই বা মন্দ কি? বেগুন পোড়াও তো ভালোবেসে খায় লোকে।
হতভাগা, অভাগারা খায়।
সুধানাথ একটু ক্লান্ত হাসি হেসে বলে, তা সবাই কি আর ভাগ্যবান হয়?
এও ভালোই। হঠাৎ অলসভঙ্গি ত্যাগ করে রান্না ছেড়ে উঠে আসে মলিনা।
তীব্রস্বরে বলে, ভালো থেকে আমাদের কী হবে বলতে পার?
সুধানাথ দাঁড়িয়ে ওঠে।
চমকে ওঠে।
বলে, কী বলছ?
যা বলছি তা বুঝতে পারবে না এত খোকা তুমি নও। আমি বলছি আমাদের কি আর কেউ সমাজে নেবে? প্রাণপণ করে ভালো হয়ে থাকলেও কেউ ভালো বলবে? আমরা যে কী করে কাটাচ্ছি, কেউ বুঝবে? বিশ্বাস করবে?
হাঁপাতে থাকে মলিনা।
সুধানাথ উত্তর দেয় না।
সুধানাথ একটা অদ্ভুত কাজ করে। সুধানাথ দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে খিলটা বন্ধ করে দেয়।
পোড়া তরকারি সুদ্ধ কড়াটা নামানো থাকে, পড়ে থাকে মাখা ময়দা। উনুনটা জ্বলে জ্বলে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, মলিনা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।
মলিনা বুঝতে পারে না কার কাছ থেকে পালাল সুধানাথ! নিজের কাছ থেকে, না মলিনার কাছ থেকে?
সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেকটা রাতে গিয়ে ঠেকে।
মলিনার হঠাৎ অজিতের সেই না-ফেরার রাতটা মনে পড়ে যায়। তেমনি বুক ছম ছম রাত যেন এটা! তেমনি ভয়ানক একটা বিপদ যেন হাঁ করে তাকে গ্রাস করতে আসছে।—যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলবে আজ মলিনা।
মলিনার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
হঠাৎ এক সময় সুধানাথের ঘরের দরজাটা খুলে যায়। মনে হয় চুলগুলো কে যেন ওর ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়েছে। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল। কাছে এসে মলিনার একটা হাত চেপে ধরে। অস্বাভাবিক গলায় বলে, চল আজ রাত্তিরে বাড়ি থেকে কোথাও বেরিয়ে যাই।
বেরিয়ে যাব!
হা! হ্যাঁ। চল না রাস্তায়, গঙ্গার ধারে, কোনো ঠাকুরতলায়। হেঁটে হেঁটে কাহিল হয়ে ফিরে আসব।
মলিনা উঠে দাঁড়ায়।
শান্তস্বরে বলে, না! এত কষ্ট তোমায় করতে দেব না। ভালো থাকার আমার দরকার নেই।
.
চার বাড়ির কাজ করা একটা ঝি, সামান্য মাইনেয় বাসন মেজে দিয়ে যায়। ভোরের ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয়, অধৈর্য কড়া নাড়ার শব্দে।
কিন্তু আজ যেন সে শব্দটা বুকের মধ্যে ঝনাৎ করে একটা লোহার ঘা মারল। যেন মলিনাকে ভয়ঙ্কর একটা শাস্তি দেবার গোঁ নিয়ে এই শব্দটা হানছে ও।
উঠি তো পড়ি করে ছুটে এসে দরাজাটা খুলে দিল মলিনা, আর সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল।
বসে পড়ল ধুলো কাদা আর জলে ভেজা গলিটায়।
যে এই শব্দের মুগুর হেনেছিল, সে কি মলিনার এই দুর্দশায় হেসে উঠল?
অস্ফুট চেতনায় ঘর থেকে মনে হল সুধানাথের একটা যেন হাসির শব্দ উঠল কোথায়।
যে হেসেছিল, সে কি ক্রুর একটা ব্যঙ্গের সুর নিয়ে কথাও বলেছিল কিছু?
মলিনারও মনে হল কী যেন বলল লোকটা। মলিনার মাথার মধ্যে শুধু শব্দটা ধাক্কা দিল। মলিনা কথাটা শুনতে পেল না।
তারপর মলিনা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল, না, না, আমি মলিনা নই।
সুধানাথ খুব জোরে একটা দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল।
সুধানাথ ভাবল ঝিটা কি অসভ্য!
এই ভোরবেলা দুম দাম! তারপর ভাবল, কিন্তু মলিনা কেন ফিরে আসছে না। ওর সঙ্গে কী এত কথা কইছে! কিন্তু নিঃসাড়েই বা কেন?
অনেকক্ষণ পরে উঠে এসে বাইরে দাঁড়াল, বলল, তোমার ঝিয়ের সঙ্গে এত দেরী হচ্ছিল কিসের?
মলিনা মাথা নেড়ে আস্তে বলল, কই আসেনি তো ঝি।
আরে! কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম, দরজা খোলার শব্দ পেলাম!
পাশের বাড়ি বোধহয়!
পাশের বাড়ি? কখনো না, কে এসেছিল বল?
মলিনা বলল, অধিকার জন্মেছে বুঝি? তাই সন্দেহ করতে শুরু করছ।
সুধানাথ একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মলিনার মুখের দিকে। আর সহজ সুরের সহজ কথা এগোল। আস্তে সরে গেল।
একটু পরে মলিনা বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না, বাইরে কোথাও খেয়ে নিতে পারবে?
সুধানাথ অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, পারব না কেন? কিন্তু–তুমি?
আমি? খাবার মতো শরীর হয়, উঠব, রাঁধব, খাব।
একটু পরে জামা জুতো পরে বেরিয়ে গেল সুধানাথ।
.
তখন ভর দুপুর।
মাধব ঘোষের বাসার জোয়ান পুরুষরা তখন সকলেই কাজের ধান্ধায় বাইরে। মেয়েরা কেউ কেউ সকালের রান্নার পাট সেরে রাতের রান্না সেরে রাখছে। কেউ বা স্কুল থেকে ফেরা ছেলেমেয়ের জন্যে রুটি গড়ে রাখছে। কেউ বা সব সেরে ভাতের কঁসি নিয়েও বসেছে।
হঠাৎ চোখ পড়ল দাস গিন্নির।
চমকে উঠে বললেন, ওমা, তুমি আবার পোড়া মুখ পুড়িয়ে কোথা থেকে?
মণ্ডল গিন্নি মুখ বাড়িয়ে বললেন, কি গো দাস দিদি?